পদ্মা সেতু চালু হতে না হতেই সেতু দিয়েই মিনিটে মিনিটে পারি জমাচ্ছে হাজার হাজার গাড়ি। মানুষের শত বছরের কষ্টের অবসান হয়েছে। মানুষ আজ কতোটা যে খুশি সেইটা ভাষায় প্রকাশ করা দুষ্কর হয়ে পড়বে। পদ্মা সেতুতে উঠেই মানুষ অনুভব করছে সীমাহীন আনন্দ ও জীবনের অনাকাঙ্খিত সুখ। সম্প্রতি জানা গেল পদ্মা সেতু দিয়ে ৬ ঘন্টায় ৮ হাজার ৯১০ টি গাড়ি পাড় হয়েছে।
উদ্বোধনের পর প্রথম আট ঘণ্টায় পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে ৮ হাজার ৯১০টি যানবাহন টোল আদায় করেছে। টোল পরিশোধের পর এসব যানবাহন পদ্মা সেতু পার হয়ে জাজিরা প্রান্তে চলে গেছে বলে সেতু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে পাঁচটি টোল কাউন্টার রয়েছে। রোববার (২৬ জুন) প্রথম টোল কাউন্টারে ১ হাজার ১৯১টি গাড়ি, দ্বিতীয় কাউন্টারে ৪ হাজার ২৫টি, তৃতীয় কাউন্টারে ২ হাজার ২৯টি গাড়ি, চতুর্থ কাউন্টারে ৮২৯টি এবং পঞ্চম কাউন্টারের মাধ্যমে ৮৩৬টি গাড়ি টোল দিয়েছে। রোববার ভোর ৫টা ৪৫ মিনিটে পদ্মা সেতুতে যান চলাচল শুরু হয়। এর আগে শনিবার (২৫ জুন) পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার বাসিন্দাদের সরাসরি সড়কপথে সংযুক্ত করেছে।
১৯৯৮ সালে যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু উদ্বোধনের পরপরই পদ্মার ওপর সেতু নির্মাণের দাবি ওঠে। তবে প্রমত্ত পদ্মার বুকে ইস্পাত-কংক্রিটের কাঠামো তৈরি করা সহজ ছিল না। সেই প্রকৌশলগত দিক বাদ দিলে পদ্মা সেতুর অর্থায়নেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। ১৯৯৮-৯৯ সালে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর ২০০১ সালের ১২ জুলাই প্রথম পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্ব চার দলীয় জোট ক্ষমতায় এলে খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি সেতু প্রকল্পের। ওয়ান-ইলেভেনখ্যাত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অবশ্য সেতুটির প্রথম প্রকল্প একনেকে পাস করা হয়। ২০০৯ সালে সেতুর নকশা প্রণয়নের প্রস্তাবে অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরুর প্রস্তাব। প্রথম দফায় সংসদে সেতুর ব্যয় সংশোধন করে নির্ধারণ করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা।
২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি সই হয়। তবে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ঋণচুক্তি স্থগিত করে বিশ্বব্যাংক। পরিস্থিতি বিবেচনায় ২০১২ সালের ২৩ জুলাই তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাগ করেন। শর্তসাপেক্ষে এ প্রকল্পে আবার ফেরতও আসে বিশ্বব্যাংক। তবে ২০১৩ সালের ৪ মে বিশ্বব্যাংকের ঋণসহায়তা প্রত্যাখ্যান করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন শেখ হাসিনা।
২০০১ সালের ১২ জুলাই প্রথম পদ্মা সেতু নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয়। এরপর দীর্ঘ চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নের মূল পাইলিং কাজের উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যান বসানো হয়। ২০১৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর স্প্যানে রেলওয়ে স্ল্যাব বসানো শুরু হয়। সড়কপথের জন্য স্ল্যাব বসানোর কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ১৯ মার্চ।
২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর সবশেষ ৪১তম স্প্যানটি বসানোর মধ্য দিয়ে ৪২টি পিলারের ওপর ৪১টি স্প্যানে পূর্ণ ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৃশ্যমান হয় পদ্মা সেতু। ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট পদ্মা সেতুতে সবশেষ সড়ক স্ল্যাব স্থাপনের পর মূল সেতুতে পিচ ঢালাইয়ের কাজ শুরু হয় ১০ নভেম্বর। ২০২২ সালের ১৭ মে পদ্মা সেতুতে যানচলাচলের জন্য টোলের হার নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ‘পদ্মা সেতু’ নামকরণ করে সেতু বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় ২৯ মে।
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো একটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের সাহস দেখান শেখ হাসিনার উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে ২৫ জুন বিশ্বে স্বনির্ভর বাংলাদেশের পরিচয়ের একটি চক্র সম্পন্ন হয়।
প্রসঙ্গত, পদ্মা সেতু দিয়ে গাড়ি খুব সহজেই এপার থেকে ওপারে চলে যাচ্ছে। পদ্মা সেতু দিয়ে যাওয়ার সময় মানুষের মুখ দেখলেই বুঝা যাচ্ছে তারা কতোটা আনন্দিত। তাদের মুখে হাসি ধরছে না। বাংলার মানুষ আজ সীমাহীন আনন্দিত।