সরকারি চাকরি যেটা একবার ছেড়ে দিলে দ্বিতীয় বার ফিরে পাবার আর কোনো সুযোগ থাকে না। তাই তো মানুষের কাছে সরকারি চাকরিটা অনেকটা সোনার হরিণের মতো। কিন্তু এমন কি শুনেছেন একবার চাকরি ছেড়ে দিয়ে সেই চাকরির টাকা ভাতা সবকিছুই নিচ্ছে অথচ সরকারি পোস্টে তার নাম নেই। হ্যাঁ সম্প্রতি এমনই একটি ঘটনা ঘটেছে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট এন্ড হাসপাতালে। একজন ডাক্তারের নামে এমন অভিযোগ উঠেছে যিনি কিনা অব্যাহতি নেওয়ার ১০ বছর পর পর্যন্ত বেতন-ভাতা সবকিছুই নিচ্ছেন আগের মতই।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হাসপাতালে ২০০৭ সালে রেডিওলজিস্ট হিসেবে যোগ দেন ফাতেমা দোজা। প্রতিষ্ঠানটি থেকে অব্যাহতি নিয়ে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে চলে যান বিএসএমএমইউতে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেখানে চাকরি স্থায়ী না হওয়ায় অসাধু উপায়ে পদোন্নতিসহ হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের হারানো চাকরির সুবিধা নিচ্ছেন তিনি।
সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়েও বিধিবহির্ভূতভাবে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হাসপাতাল থেকে ১০ বছর ধরে বেতন, ভাতা, বোনাস নিচ্ছেন ফাতেমা দোজা নামে এক চিকিৎসক। অথচ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, একবার সরকারি চাকরি ছাড়লে তা ফিরে পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
২০০৭ সালে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হাসপাতালে রেডিওলজিস্ট হিসেবে যোগ দেন ফাতেমা দোজা। ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠানটি থেকে অব্যাহতি নেন তিনি। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগে।
তবে ছয় মাস পর বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় চুক্তির মেয়াদ আর বাড়ায়নি। সেখানেই কারিশমা দেখান এই চিকিৎসক। অব্যাহতি নিলেও নিয়মবহির্ভূতভাবে পদোন্নতি নিয়ে ফিরে আসেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে।
যদিও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, একবার সরকারি চাকরি ছাড়লে তা ফিরে পাওয়ার আর কোনো সুযোগ থাকে না। ফাতেমা দোজা তাহলে কীভাবে চাকরি ফিরে পেলেন এবং পদোন্নতি নিলেন, তা অবাক করছে অনেককে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও।
এই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মিনা মাসুদ উজ্জামানের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। বেঁধে দেয়া সময় শেষ হচ্ছে আগামী বুধবার।
তদন্ত কমিটির এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, অভিযুক্ত চিকিৎসককে সশরীরে সোমবার সচিবালয়ে ডাকা হয়েছে। চিকিৎসক ফাতেমা দোজার বক্তব্যের পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সবকিছু জেনে নির্ধারিত সময়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে।
দুটি প্রতিষ্ঠানে ফাতেমা দোজার নিয়োগপত্র, পদোন্নতি, অব্যাহতিসহ বিভিন্ন তথ্যের কাগজের কপি এসেছে নিউজবাংলার হাতে।
এসব কাগজ থেকে জানা যায়, ফাতেমা দোজা ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। ২০০৭ সালে তিনি রেডিওলজিস্ট পদে জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে যোগ দেন। ২০০৯ সালে পদ পরিবর্তন করে তিনি (পরিচিতি নম্বর-৪২৭৩৭) মেডিক্যাল অফিসার পদে যোগ দেন। এই পদে কর্মরত ছিলেন ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
এরপর স্বায়ত্তশাসিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে ছয় মাসের জন্য নিয়োগ পান।
সেখানে যোগ দিতে ২২ ফেব্রুয়ারি সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতি চেয়ে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালকের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সচিব বরাবর লিখিত আবেদন করেন। আবেদন পরিচালক জমা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
সব ধরনের প্রক্রিয়া শেষে বিএসএমএমইউতে যোগ দেন ফাতেমা দোজা। তবে ছয় মাস পর তার চাকরিটি স্থায়ী করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ সময় তিনি বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালেও প্র্যাকটিস করতেন।
অভিযোগ রয়েছে, বিএসএমএমইউতে চুক্তিভিত্তিক চাকরি স্থায়ী না হওয়ার কারণে বিভিন্ন পর্যায়ে তদবিরের মাধ্যমে আবার হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ফিরে আসেন ফাতেমা। পদোন্নতিসহ নিয়মিত নিচ্ছেন বেতন-ভাতা।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের সে সময়ের চেয়ারম্যান এনায়েত করিমের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তিনি বলেন, ‘তখন তার বিভাগে ডা. ফাতেমা দোজা ছিলেন কি না মনে করতে পারছি না। কারণ এ রকম অনেকে আসছে, আবার চলেও গেছে। সঠিক তথ্য জানতে বিএসএমএমইউর তখনকার রেজিস্ট্রার বা চেয়ারম্যান ভালো বলতে পারবেন। তাদের কাছে তথ্য-প্রমাণসহ অন্যান্য কাগজপত্র থাকবে।’
ওই সময় বিএসএসএমএমইউর রেডিওলজি বিভাগে প্রশাসনিকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আল আজাদ। ফাতেমা দোজার বিষয়ে প্রশ্ন তুললে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
বিএসএমএমইউর তৎকালীন রেজিস্ট্রার (অতিরিক্তি দায়িত্ব) অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম, যার স্বাক্ষরিত চিঠিতে ফাতেমাকে প্রতিষ্ঠানটিতে যোগ দিতে বলা হয়েছিল। সেই শফিকুলের সঙ্গেও কথা বলেছে নিউজবাংলা।
তিনি বলেন, ‘যেহেতু চাকরির বিষয়, এটা তার ব্যক্তিগত। এ বিষয়ে তিনিই ভালো বলতে পারবেন।’
পরে প্রতিবেদক জাতীয় হদরোগ ইনস্টিটিউটের তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল সাফী মজুমদারের সঙ্গে কথা বলেন, যিনি অব্যাহতিপত্র গ্রহণ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক বরাবর দরখাস্ত দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আবেদন করেছিলেন।
আব্দুল্লাহ আল সাফী বলেন, ‘অনেক বছর আগের বিষয়। এখন আমি হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে আর চাকরি করি না। এ বিষয়ে আর খোঁজখবর রাখি না। (ডা. ফাতেমা দোজা) ইস্তফা দিয়ে বিএসএমএমইউতে চাকরি করে ফের কীভাবে হৃদরোগে এলেন বলতে পারব না।
‘বর্তমান পরিচালক এবং তার সহকর্মী যারা আছেন তাদের জিজ্ঞেস করেন। আমি তার অব্যাহতির জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বরাবর সুপারিশ করলেও এখন সঠিকভাবে মনে করতে পারছি না। আমি থাকাকালে তিনি পুনরায় যোগদান করছেন এমনটা হওয়ারও কথা না। যদি হয়ে থাকে কাগজপত্র দেখলে বোঝা যাবে।’
এ বিষয়ে জানতে নিউজবাংলা কথা বলে ফাতেমা দোজার সঙ্গে। বিধিবহির্ভূতভাবে চাকরি ফিরে পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দেন তিনি। এরপর একাধিকভার ফোন করলেও রিসিভ করেননি। কিছুক্ষণ পর প্রতিবেদকের দুটি নম্বরই ব্ল্যাকলিস্টে রেখে দেন।
এরপর একই প্রশ্ন লিখে ফাতেমা দোজার হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো হলে তিনি সিন করলেও কোনো জবাব দেননি।
এটা আসলেই ভাবনার বাইরের মত একটি ঘটনা। চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়েও ১০ বছর কিভাবে তিনি বেতন নিচ্ছেন। যদিও ওই ডাক্তারের মতে তিনি আবার জয়েন করেছিলেন। কিন্তু সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতি নেওয়ার পর জয়েন করার কোনো সুযোগ থাকে না। অবশ্য এ ব্যাপারে তদন্ত নেওয়ার কথা জানিয়েছে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এখন দেখার বিষয় তদন্ত শেষে কি জানা যায়।