গভীর রাত। নম্বর প্লেটহীন সাদা রঙের মাইক্রোবাস। হঠাৎ গতিরোধ করে দাঁড়ালে বুঝবেন, সামনে স্বয়ং যমদূত! নিশ্চিত মৃত্যু অথবা কাছাকাছি নিয়ে যাবে আপনাকে। রাজশাহী অঞ্চলে আঁধার নামলেই এমন যমদূতবাহী হয়ে উঠেছে একটি সাদা মাইক্রোবাস। জেলায় দুই চিকিৎসকের আলোচিত হত্যা, হরিয়ান বাজারে এক ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যাচেষ্টা, লালপুরে যুবদল নেতাকে কুপিয়ে মৃত ভেবে গর্তে ফেলে যাওয়ার সব ঘটনাতেই পাওয়া গেছে সাদা মাইক্রোবাসটির সংশ্লিষ্টতা।
পুলিশের তদন্ত দল আরও জানায়, তিনটি ঘটনায় সাদা মাইক্রোবাসের সিসিটিভি ক্যামেরার ভিডিও ধরা পড়েছে। তবে নম্বর প্লেট না থাকায় কোনো কর্নার তৈরি করা যায়নি।
এই আক্রমণগুলির মধ্যে আরেকটি জিনিস মিল রয়েছে। হামলার শিকার সবাই জামায়াত-বিএনপি সমর্থক বা কর্মী। ঘটনার সূত্রপাত ২৯ অক্টোবর। ওইদিন সন্ধ্যার পর পবা উপজেলার কিস্তোগ্রাম বাজারে তার চেম্বার থেকে জিপি এরশাদ আলী দুলালকে ফিল্মি স্টাইলে একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি জামায়াতের সমর্থক ও অর্থদাতা। রাজশাহীর সিটিহাট এলাকায় দুই উরুতে ছয়টি ছুরিকাঘাতে তাকে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ ও তদন্ত দল বলছে, একজন দক্ষ পেশাদার সন্ত্রাসী দুলালকে হত্যা করেছে। তাকে তুলে নেওয়ার সময় পথচারীরা এগিয়ে এসে গুলি ও ককটেল নিক্ষেপ করলে মাইক্রোবাসটি আটকে যায়।
ওই ঘটনার তিন ঘণ্টা পর রাত সাড়ে ১২টার দিকে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ও ভেরিওলজিস্ট ডা. গোলাম কাজেম আলী আহমদকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। তার হৃদয় বরাবর তিনটি নিখুঁত ছুরির ক্ষত ছিল। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, তিনটি ক্ষতই তার হৃদয়ে বিদ্ধ হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডে সাদা মাইক্রোবাসও ব্যবহার করা হয়। কাজেম রাজশাহী মেডিকেল কলেজ শাখা ক্যাম্পের সাবেক সভাপতি ডা.
ওই রাতে ড. কাজেমের সঙ্গে থাকা শাহীন আলম পুলিশকে জানান, পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী দেখে ফেরার পথে একটি সাদা মাইক্রোবাস তাদের মোটরসাইকেলটিকে প্রমানলী জংশনে থামায়। মাইক্রোবাস থেকে তিনজন নেমে কাজেমের পায়ে আঘাত করে। রাস্তার ওপর পড়ে গেলে দেড় থেকে দুই মিনিটের মধ্যে বুকে তিনটি আঘাত করে ওই ব্যক্তিরা মাইক্রোবাসে করে পালিয়ে যায়।
পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, মাইক্রোবাসটিতে কোনো নম্বর প্লেট ছিল না। এ কারণে সিসিটিভি ক্যামেরার ভিডিওতে তাকে রাজশাহী-ঢাকা রুটে চলাচল করতে দেখা গেলেও তারা তাকে শনাক্ত করতে পারেনি।
গত শুক্রবার লালপুরের বিলমারিয়া ইউনিয়ন যুবদল নেতা মাসুদ রানাকে একইভাবে সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায় একদল। তারা মাসুদকে একটি নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে রড দিয়ে পিটিয়ে তার ডান হাত ও ডান পা ভেঙে দেয়। ছুরি দিয়ে লাশ বিকৃত করার পর মৃত ভেবে গর্তে ফেলে রেখে যায়।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মাসুদ জানান, সোয়া ১০টার দিকে দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরার পথে সাদা মাইক্রোবাসে চারজন এসে তাকে তুলে নিয়ে যায়। নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করার পর ওরা বলল, শালা, ঢাকায় গিয়েছিলে? আপনি কি বিএনপি করেন? থানায় যান; আমি বিএনপি করছি।’ এরপর তারা গোপালপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজে নিয়ে গিয়ে নির্যাতনের পর মৃত ভেবে গর্তে ফেলে দেয়। পরে স্থানীয় লোকজন ও পুলিশের সহায়তায় তাকে উদ্ধার করা হয়।
মাসুদ বলেন, একজন দুর্বৃত্ত কথা বলেছে, আমি তাদের চিনতে পারিনি। কে করেছে, কেন করেছে- কিছুই বুঝলাম না। যাইহোক, যিনি কথা বলেছেন তাকে একজন শিক্ষিত এবং ভদ্রলোক বলে মনে হয়েছিল।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেডে শুয়ে মাসুদ সমকালকে বলেন, আমি নাটোরের লালপুর উপজেলার বিলমারিয়া ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি ও যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। কিন্তু এখন কোনো পদ নেই। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কিছু বলি না। কিন্তু কেন আমাকে এভাবে হত্যা করা হলো, কিছুই বুঝতে পারলাম না।
এর আগে ৪ অক্টোবর হরিয়ান বাজারের টিভি-ফ্রিজ ব্যবসায়ী শাহীন আলমকে তার দোকানে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ সময় তার চিৎকারে অন্যরা এগিয়ে আসলে হামলাকারীরা গুলি ছুড়ে সাদা মাইক্রোবাসে করে পালিয়ে যায়।
আহত শাহীন জানান, তার পরনে হেলমেট ছিল
দু’জন লোক তার দোকানে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, তুমি বিদ্যুৎ? শাহিন এ কথা বলার সাথে সাথে একজন তার বুকের বাম পাশে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করে। আরেকজন তার বাম কনুইতে পিস্তল দিয়ে গুলি করে। এরপর পাইপ দিয়ে আঘাত করে তার ডান হাত ভেঙে দেয়। মাথায় দুটি কোপও দেওয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে জানান, একটি সাদা মাইক্রোবাসে করে দলটি এসেছিল। দোকানের ভেতরে দুইজন ও বাইরে তিনজন অস্ত্রসহ ছিল। মাইক্রোবাসে আরো দুজন ছিলেন।
শাহীন আরও বলেন, ‘আমি জীবনে প্রথম এই মানুষগুলোকে দেখলাম। তারা কিছুই নেয়নি। মেরে গেছে। আমার অপরাধ কী জানতে চাইলে তিনি কোনো জবাব দেননি। সাদামাটা পোশাকের মানুষগুলো লম্বা-চওড়া, প্রশাসনের লোক বলে মনে হয়। তিনি আরও বলেন, আমি কোনো রাজনীতি করি না। কিন্তু বিদ্যুতের নাম জিজ্ঞেস করা হলো, তিনি জামায়াত-শিবির করেছেন। প্রায়ই জেলে। সে আমার খুব কাছের। আমাকে মেরে বাইরে গেলে ওরা বলল, এটা একটা ভুল ছিল।
এ প্রসঙ্গে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার বলেন, পুলিশ সিসিটিভি ক্যামেরায় সাদা মাইক্রোবাসটির ফুটেজ পেয়েছে।