শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতা একজন মানুষকে কতটা অমানবিক জীবন যাপনে বাধ্য করতে পারে তার এক নতুন নমুনা দেখা গেলো। নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলার কালিকাপুর গ্রামে মাত্র দেড় বছর বয়সে পিতা হারানো মানসিক প্রতিবন্ধী সাইফুল ইসলাম সুদীর্ঘ ১২ বছর ধরে খোলা আকাশের নীচে বসবাস করছেন।
সাইফুলের মা হেলেনা বেগম জানান, সন্তান জন্মের মাত্র দেড় বছর পর স্বামীকে হারানোর পর কখনও ভিক্ষা করে, কখনও ঝির কাজ করে ছেলেকে বড় করেছেন। ছেলে বড় হয়ে রিকশা-ভ্যান চালিয়ে সংসারের হাল ধরে। এর পর ছেলেকে বিয়ে দেন, তাদের সংসারে জন্ম নেয় মিলন ও মীম নামে দুই সন্তান। তবে মীম মায়ের গর্ভে থাকাবস্থায়ই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি সাইফুল পাগল হয়ে যায়।
তিনি আরও জানান, বর্তমানে সাইফুলের ছেলে মিলন (১৫) বনপাড়া মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে এবং মেয়ে মীম (১২) বেগম রোকেয়া সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। দুই সন্তানকে লেখাপড়া করাতে সাইফুলের স্ত্রী বর্তমানে অন্যের বাড়িতে ঝির কাজ করেন।
তিনি নিজেও বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করেন বলে জানান হেলেনা বেগম।
স্থানীয় স্কুলশিক্ষক আলফুর রহমান জানান, প্রায় ১২ বছর আগে সাইফুলের মস্তিষ্কে সমস্যা দেখা দিলে অর্থাভাবে সুচিকিৎসা করা সম্ভব হয়নি। সেই থেকে খোলা জায়গাতে মলমূত্র ত্যাগ করে, কখনও কখনও জিনিসপত্রও ভাঙচুর করে। তাই পরিবারের লোকজন তার বাড়ির পাশে পলিথিন ও চটের বেড়া দিয়ে ছাউনি করে দিয়েছে তার বসবাসের জন্য। আর হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে ছাউনিসংলগ্ন সুপারির গাছের সঙ্গে শিকল বেঁধে তার পায়ে পরিয়ে রাখে। তবে মাঝে মাঝে শিকল মুক্ত করা হয়।
সাইফুলের স্ত্রী মিনা খাতুন বলেন, ‘মাত্র ২ শতাংশ জমিতে ভাঙাচোরা কাঁচাঘরে পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছি। আর স্বামী জঙ্গলের পাশে শীত-গ্রীষ্ম বারো মাস একটি ছাউনিতে থাকে। আয় বলতে শুধু আমার স্বামীর নামে মাসিক বরাদ্দের প্রতিবন্ধী ভাতার কয়েকটা টাকা। জীবন চালাতে উনি অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই আমি ও আমার শ্বাশুড়ি অন্যের বাড়িতে ঝির কাজ করি।’
তার ছেলে মিলন ও মেয়ে মীম আবেগতাড়িত কণ্ঠে জানায়, বাবার কাছে সন্তানদের কত চাওয়া-পাওয়া থাকে। আমাদের সমবয়সি বন্ধুরা তাদের বাবার কাছে কত আদর পায়, ভালোবাসা পায়। কিন্তু আমাদের বাবার কাছে কোনো চাওয়া-পাওয়ার সুযোগ নেই। উল্টো যখন জঙ্গলের পাশে শিকলে বাঁধা অবস্থায় বাবাকে দেখি তখন ভীষণ কষ্ট হয় আমাদের। যদি কেউ বাবাকে চিকিৎসা করে সুস্থ করে দিত, তা হলে আমরাও মাথার ওপরে বাবার ছায়া পেতাম, আরও পেতাম বাবার ভালোবাসা।
প্রতিবেশী পরিতোষ কবিরাজ বলেন, ‘মানসিক ভারসাম্যহীন সাইফুলকে সুচিকিৎসা দেওয়া হলে সে সুস্থ হয়ে উঠবে বলেই আমার বিশ্বাস। কোনো দানশীল ব্যক্তি বা সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান যদি তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করত, তা হলে একটি পরিবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে পারত।’
বনপাড়া পৌর মেয়র কেএম জাকির হোসেন বলেন, ‘আমি তার জন্য একটি টয়লেট নির্মাণ ও ছেলেমেয়ের পড়াশোনার বিষয়ে আমার সামর্থ্য অনুযায়ী সহযোগিতা করব।’
ইউএনও মোসা. মারিয়াম খাতুন বলেন, ‘খোঁজখবর নিয়ে আমি যতটুকু পারি সহযোগিতা করব।’
উপজেলা চেয়ারম্যান ডা. সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, ‘বিষয়টি আগে জানতাম না। তবে তার চিকিৎসাসহ অন্যান্য কাজে ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা করব। এ ছাড়া উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে যেটুকু সম্ভব সহায়তা প্রদানের চেষ্টা করা হবে।’
প্রসঙ্গত, দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাইফুলের মত আরও অনেক মানসিক প্রতিবন্ধকতার শিকার ব্যক্তিই সুচিকিৎসার অভাবে শিকলবন্দী হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, সকলের মিলিত সচেতনতা হয়তো এই মানুষদের স্বাভাবিক জীবনে পদার্পন করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারতো।