বাংলাদেশের সব থেকে বড় এবং চীর প্রতিদ্বন্দী রাজনৈতিক দল দুটি হলো আওয়ামীলীগ এবং বিএনপি। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এই দল দুটি একে অপরের শত্রু হিসেবেই বজায় রেখেছে সম্পর্ক। এ দিকে এবার এই দুই দলের সার্বিক দিক বিবেচনা করে এবং কিছু ইতিহাস তুলে ধরে একটি লেখনি লিখেছেন সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক দীপক চৌধুরী।পাঠকদের উদ্দেশ্যে তার সেই লেখনি তুলে ধরা হলো হুবহু:-
এখন যারা সুশাসন, গণতন্ত্র, সুবিচার নিয়ে হাহাকার করছেন, পত্রিকায় কলাম লিখছেন, টেলিভিশনের আলোচনা বা টকশোতে ঝড় তুলছেন তারা বাংলাদেশের অতীত সম্পর্কে একটি কথাও স্মরণ করতে চান না। বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল সাহেব ও তার চিন্তার সমমানের রাজনৈতিক নেতারা ‘গণতন্ত্র’ নিয়ে হাঁ-হুতাশ করে চলেছেন। আর প্রতিদিনই সরকারের ‘বিদায়ঘন্টা’ বাজাচ্ছেন। এই দলের সমমনা ইসলামী দলগুলোও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের সমালোচনা করতে বিএনপি নেতাদের বক্তৃতা সুবিধামতো অনুসরণ করছে। এখন তারা বক্তৃতায় গণতন্ত্রের জন্য চোখের জল ফেলে ভাসিয়ে দিচ্ছেন। মায়াকান্না করছেন। তারা গণতন্ত্র, মানবতা, সুশাসন, সুবিচারের ছিটেফোঁটাও দিতে পারেননি। দেশের জনগণ জানেন, গণতন্ত্র ক্যান্টনমেন্টে বন্দি ছিল দীর্ঘদিন। দলের জন্মদাতা জিয়াউর রহমানের কীর্তি ইতিহাসে লেখা রয়েছে। শত-সহস্র মুক্তযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে। খুন-গুম, সর্বহারাদের তাণ্ডব টিকিয়ে রাখা, চুরি আর লুটপাট এসবই ছিল বিএনপি-জামায়াত সরকার আমলে নিত্যদিনের ঘটনা। কিন্তু পত্র-পত্রিকায় ইনিয়ে-বিনিয়ে যারা কলাম লিখেন বা টকশোতে যারা গলা শুকিয়ে ফেলেন তারা কারা? আসলে, গণতন্ত্রের সঙ্গে বিএনপির কখনো দেখা হয়নি। কারণ, বিএনপি নামের দলটির জন্মই নিয়েছিল অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। জনগণের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। অস্ত্রের মুখে রাজনীতিবিদদের চরিত্র হরণ করা ছিল এদের পূর্বসুরি নেতাদের কাজ। বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে গণতন্ত্র হত্যার খেলায় মজেছিল দলটির নেতারা।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সেদিন প্রেসক্লাবের সামনে ‘গলা ফাটানো’ বক্তৃতা দিচ্ছিলেন এই বলে যে, ‘আর সময় নেই। এখন জেগে উঠতে হবে। ভয়াবহ ফ্যাসিবাদী ও দুর্নীতিবাজ সরকারকে একটা ধাক্কা লাগাতে হবে।’ কিন্তু বিএনপি-জামায়াত সরকার আমলে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও মানবতা কী রকম আশঙ্কাজনক অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছিল বাংলাদেশ- তা কী মনে আছে বিএনপি নেতাদের? দুর্নীতিতে দলটির সরকার পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এই দলটির নেতারা কীভাবে দুর্নীতির কথা বলেন! কানসাটে বিদ্যুৎ দাবি করার কৃষকদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। সেই তারা কীভাবে বিদ্যুৎ প্রসঙ্গে কথা বলে? দুনিয়ার খবর কী বিএনপি-জামায়াত জানে? অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্সসহ পৃথিবীর নামকরা দেশগুলো এখন কোন্ অবস্থায় পড়েছে এটা জানা দরকার।
মানবিক দৃষ্টি দেখিয়ে খালেদা জিয়াকে যেন উন্নত চিকিৎসার জন্য যেন বিদেশে পাঠানো হয় সেজন্য শুধু বিএনপি নয়, বিভিন্ন সুশীল মহল দাবি জানাচ্ছে। খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য মানবিকতার কথা বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, যে রাজনীতির উর্ধ্বে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখাতে হবে। হাঁ, দেখাতে হবে। ১০ বছর তিনি এ দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা হোক আমরা চাই। কিন্তু যারা মানবিকতা দোহাই তুলে জিগির করছেন তারা কারা? আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতার বাইরে ছিল আর বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন মানবতা কোথায় ছিল? আইনের শাসন, গণতন্ত্র, সুবিচার কোথায় ছিল? আজকের বাংলাদেশের পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, ফ্লাইওভারসহ অগ্রগতি, উন্নয়ন আর গণমানুষের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন যারা চোখে দেখে না তারা গণতন্ত্র খুঁজে পাবে কীভাবে? একজন মানুষ কতটা অমানবিক হলে রাষ্ট্রের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাৎ দিবসে ভুয়া জন্মদিনের উৎসব করেন। ১৫ আগস্টের ভুয়া জন্মদিন পালন ছিল নিষ্ঠুর রসিকতা। এদিন আমাদের জাতীয় শোক দিবস। জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার বিয়োগান্তক দিন। দেশের রাজনীতিতে এবং জনগণের সাথে কতটুকু মানবিক আচরণ করেছিলেন খালেদা জিয়া? এর মানে এই নয় যে, আমি খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার জন্য বিদেশ গমনের বিষয়ে বিরোধিতা করে মন্তব্য করছি।
সবাই জানেন তবুও কিছু বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন ডিপ্লোম্যাট। ২০০৫-এর ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জের বৈদ্যের বজারে এক জনসভায় বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা গ্রেনেড হামলা চালায়। একইসাথে নির্বিচারে গুলি চালায়। গুলিবিদ্ধ হন তিনি। হবিগঞ্জে চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল অপ্রতুল। তখন সরকারের কাছে একটি হেলিকপ্টার চাওয়া হয়েছিল। চিকিৎসকরা সেই অবস্থায় তাকে ঢাকায় নেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। কিন্তু খালেদা জিয়া হেলিকপ্টার দিতে সরাসরি অস্বীকৃতি জানান।
২০০১ এর অক্টোবরের নির্বাচনের পর সারাদেশে তাণ্ডব চালানো হয়। সেই ম্যানিপুলেটেড নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয় বিএনপি-জামায়াত। পর পরই বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার সারাদেশে তাণ্ডব চালায়। হিন্দুদের বাড়িঘর দখল ও লুটপাট এবং ধর্ষণ আর খুন চলে একের পর এক। কারণ, হিন্দুরা নৌকায় ভোট দেয় এটা ওদের অভিযোগ।
দেশের নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার ইতিহাসে এটি একটি নৃশংস অধ্যায়। জাতির সামনে ছিল ভয়াবহ নিষ্টুরতা। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী এবং ভোটারদেরকে চিরতরে নির্মূল করার জন্য সশস্ত্র হামলা, আক্রমণ, লুটপাট, দেশত্যাগে বাধ্য করা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায়।
মির্জা ফখরুল কয়েকমাস আগে বলেছেন খালেদা জিয়া নাকি দেশের ‘প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা’। যদিও তিনি যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানান। বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হওয়া দেশবিরোধী সংগঠন জামায়াত এবং দলের নেতাদের মন্ত্রী বানান, উপদেষ্টা করেন। খালেদা জিয়ার আশীর্বাদে জাতির পিতার আত্মস্বীকৃত খুনিদেরকে জাতীয় সংসদে বসিয়ে পবিত্র সংসদের অবমাননা করেছিলেন। এদেশের জনগণ ভুলে যায়নি।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কেবল সপরিবারে হত্যাই করা হয়নি বরং এই হত্যাকাণ্ডের যেন বিচার না হয় সেজন্য বিচারের পথ রুদ্ধ করেছিলেন খুনি মোশতাক এবং জিয়াউর রহমান। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন জিয়া কিন্তু বাতিলের দাবি জানালে খালেদা জিয়ারা ঘাতক-খুনিদের কাছে টেনে নেন।
১৯৯১ সালে যখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যখন শপথ নেন তখন খালেদা জিয়ার সামনে সুযোগ এসেছিল এই কালো আইনটি বাতিল করার। কিন্তু খালেদা জিয়া কালো আইনের পক্ষে অবস্থান নেন।
ভয়ংকর গ্রেনেড হামলার কথা কী ভুলবার। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ছিল বিএনপি-জামায়াতের একটি মাস্টারপ্ল্যান। খালেদা জিয়া তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। খালেদা জিয়া এই গ্রেনেড হামলার পর দুঃখ প্রকাশ করেননি বরং তিনি তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা ‘ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়েছিলেন’ বলে এমন উদ্ভট, অমানবিক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করেছিলেন। কী রকম ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা ছিলো এটি যা সারাবিশ্ব আলোচিত ও নিন্দিত। আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করা এবং শেখ হাসিনাকে চিরতরে শেষ করে দেয়ার জন্য গ্রেনেড হামলার এই ঘৃণ্য ঘটনা হয়েছিল। ’১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় আর ২০০৪-এর ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে চিরতরে শেষ করে দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। আমি প্রশ্ন করতে চাই, তখন মানবতা, সুশাসন, সুবিচার আর মানবিকতা কোথায় ছিল?
প্রসঙ্গত, বর্তমানে বেগম খালেদা জিয়া নিজের বাড়িতে আটকে আছেন অসহায় অবস্থায়। দীর্ঘদিন ধরেই তার চিকিৎসার দাবি জানিয়ে আসছে দলটিআা।কিন্তু এ নিয়ে এখনো সরকার থেকে আসেনি কোন ধরনের স্বদুত্তর।