বাংলাদশের অনেক সাবেক সেনাকর্মকর্তারা রয়েছেন যারা এখন বিদেশে অবস্থান করছেন পাকাপাকি ভাযে। এদের মধ্যে একজন হচ্ছে মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বাংলাদেশের অনেক কিছুই জানেন। ছিলেন দেশের সেনাবাহিনীর একজন তুখোড় কর্মকর্তা। সম্প্রতি তার ধারাবাহিক লেখা লেখির আরেকটি বিষয় প্রকাশ করেছেন তিনি। পাঠকদের উদ্দেশ্যে তার সেই লেখনী তুলে ধরা হলো হুবহু :-
জিয়ার বিশ্বাসঘাতকতা-২
আমার একদা বেস্ট ফ্রেন্ড জিয়াউল আহসান ২য় বার ফ্রেন্ডশীপ কোড ব্রেক করে গত নির্বাচনের আগে। বন্ধু তখন লে: কর্নেল (অব:) তৌহিদ স্যারকে (১২ তম লং কোর্স এবং ১ প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ানের ৭ম অধিনায়ক)ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়। স্যারের অপরাধ তিনি বেগম খালেদা জিয়ার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। ঘটনাটি আমেরিকায় বসে জানতে পেয়ে আমি এ বিষয়ে যখন অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার ফোরাম এবং আমার ফেসবুকে পাবলিকলি লেখালিখি শুরু করি তখন জিয়া আমাকে বাংলাদেশ থেকে ফোন করে।
: দোস্ত, তুই তৌহিদ স্যারকে নিয়ে কেন লিখালিখি করতেছিস?
: আমি কেন লিখব না? স্যারকে কোন অভিযোগের ভিত্তিতে এ্যারেস্ট করছিস? তুই আমি একসাথে তৌহিদ স্যারের সাথে কমান্ডো ব্যাটালিয়ানে চাকুরী করসি! তার আগে স্যার আমাদের দুইজনেরই প্রশিক্ষক ছিলেন। তুই কেমনে পারলি?
: স্যার কি করসিল জানিস?
: বল কী করছিল স্যার
: স্যার সরকারের বিরুদ্ধে আর্মি নামাইতে চাইসিল!
:তাই? একজন অবসরপ্রাপ্ত লে: কর্ণেলের এত তেজ? তাইলে তুই স্যারের বিরুদ্ধে ক্যু করার চার্জ না দিয়ে এক বছর আগের রাজনৈতিক জ্বালাও পোড়াও টাইপ মামলায় অজ্ঞাত আসামীর যায়গায় স্যারকে ঢুকাইলি কেন বল!
এবারে জিয়া নীরব। তাকে বললাম দোস্ত, ফ্রেন্ডশীপ আর রাজনৈতিক বিশ্বাসকে একত্রে মিলাইশনা।
: তুইতো দেশে আসলে বিপদে পড়বি!(বন্ধু হুমকি দিল নাকি?)
: শোন তাইলে, আমি বিপদে পড়লেও তোর কাছে সাহায্যের জন্য যাবো না, এটা নিশ্চিত থাকিস।
এটাই ছিল জিয়ার সাথে আমার সর্বশেষ কথোপকথন। তার প্রচ্ছন্ন হুমকির বিপরীতে তাকে ফেইসবুকের বন্ধু তালিকা থেকে বাদ দিলাম। যে বন্ধু বুকে নাই, তাকে ফেইসবুকে রেখে কী হবে?
এখান তৌহিদ স্যারের গ্রেফতারের ঘটনাটা বিস্তারিত বলি। লে: কর্নেল তৌহিদুল ইসলাম স্যার গ্রেফতারের সংবাদ পাওয়া পাত্র আমি আমাদের অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারদের ফোরামে সেই ঘটনার উল্লেখ করে তার বিস্তারিত জানতে চাইলাম। তখন বেশ কয়েকজন অফিসার নিশ্চিত করেন যে স্যারকে ডিবি তুলে নিয়ে গেছে। এর একদিন পরে একজন সার্ভিং অফিসার আমাকে একটা অডিও ক্লিপ পাঠালেন। সেই ক্লিপ শুনে জানতে পারলাম যে, ২৪/২৫ জনের একটা দল বাসার গ্রীল কেটে ভিতরে ঢুকে লুংগী আর টিশার্ট পরা অবস্হায় স্যারকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেছে। তাদের কেউ ইউনিফর্মে ছিল না আর ৫ জন ছিল হাতাকাটা গেঞ্জি, ছেঁড়াখোঁড়া প্যান্ট আর স্যান্ডেল পরা। এদের একজন মিসেস তৌহিদকে বলেছিল যে তারা ডিবি। ভাবী তার বিসিএস ব্যাচমেট ডিবিতে পোস্টিং এক অফিসারকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন যে তোদের দুলাভাইকে কোথায় নিয়ে গেছিস? তাকে কাপড়চোপড় আর ব্যক্তিগত কিছু জিনিস দিতে হবে। সেই ডিবি অফিসার বললেন, কই আমরা তো উনাকে তুলে আনিনি। ভাবী এতে ভীষণ আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং এটুকু শুনে আমিও প্যানিকড হই।
আমি সাথে সাথে প্রথম আলোর পরিচিত এক সাংবাদিককে ফোন করে বিস্তারিত জানিয়ে এটা দ্রুত নিউজ করার অনুরোধ করলাম। প্রথম আলোতে সংবাদটি ছাপা হওয়ার দিন সম্ভবত বিকেলে তৌহিদ স্যারকে আদালতে হাজির করা হয়। আমি অবাক হয়ে অনুধাবন করার চেষ্টা করলাম জিয়া, আমি আর তৌহিদ স্যার একসাথে ১ প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ানে চাকুরী করেছি এক সময়। শুধু তা’ই নয়, তৌহিদ স্যার যখন কমান্ডো ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক ছিলেন তখন জিয়া ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় অফিসার। ব্যাটালিয়ানের যত কেনাকাটা বিশেষত: ক্যান্টিনের কেনাকাটা সব তৌহিদ স্যার জিয়ার মাধ্যমে করাতেন। জিয়া ছিল তৌহিদ স্যারের সবচেয়ে বিশ্বস্ত অফিসার।
২০০৭ সালে ১ প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ানের বেসরকারী কার্পেন্টার ময়না মিয়ার বিপক্ষে একটি পারিবারিক জমিজমা সংক্রান্ত মামলা থাকলে সেটার পক্ষে তৌহিদ স্যার এবং জিয়া উভয়ই সিলেট কোতোয়ালী থানার তৎকালীন ওসি আব্দুর নূরের নিকট সুপারিশ করেন। পরবর্তীতে সিলেট শাখা এএসইউ এ বিষয়ে বিস্তারিত তদন্ত করে রিপোর্ট প্রদান করে। এর কিছুদিন পূর্বে (০২ নভেম্বর ২০০৬) জিয়া প্যারাসুট ভাঁজ চলাকালে কর্পোরেল আলাউদ্দিন (একজন দক্ষ জাম্পমাস্টার এবং প্রশিক্ষক)কে ৬ জোড়া বুটলেস আনার জন্য বললে তিনি ক্যান্টিন খোলা না থাকায় নিজের ব্যবহার করার ৬ জোড়া বুটলেস নিয়ে আসায় জিয়া তাকে শারিরীক ভাবে লাঞ্ছিত করে। পরবর্তীতে লে: কর্নেল তৌহিদের হস্তক্ষেপে কর্পোরাল আলাউদ্দিনকে সাথে সাথে আরএমও এর কাছে পাঠায় এবং তিনদিনের সিক ইন কেয়ার্টার দেয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে গোয়েন্দা সংস্হা নড়াচড়া করলে তৌহিদ স্যার তাকে রিফ্রেসার জাম্পের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেন। এ বিষয়েও এএসইউ এর একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন আছে। যে তৌহিদ স্যার জিয়াকে অধিনায়ক হিসাবে বরাবরই রক্ষা করেছেন আর ক্ষমতা পেয়ে জিয়া তার এবং তার পরিবারের প্রতি কতটা নির্দয়!
মাফিয়াদেরও অন্তত ভাল একটা এথিকস্ আছে যে তারা নিজ পরিবারকে সবসময় রক্ষা করে। আমি আর বোরহান দুজনেই জিয়ার কোর্সমেট ও দীর্ঘদিনের বন্ধু। জিয়া কীভাবে আমাদের ফোন কল রেকর্ড করলো? তার উদ্দেশ্য কী?? রেকর্ডই যদি করলো, তারপরও তো সে আমাকে বা বোরহানকে বলতে পারতো যে এমন একটা ফোন রেকর্ড সে শুনেছে, আমরা যেন ভবিষ্যতে ফোনে এমন কথাবার্তা আর না বলি! তৌহিদ স্যার কমান্ডো লাইনের একজন সাক্ষাৎ লিজেন্ড এবং মাল্টি ট্যালেন্টেড একজন অফিসার। স্যার বরাবরই আউটস্পোকেন এবং সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি কমান্ডো ব্যাটালিয়ানের প্রতিটি সৈনিক এবং অফিসারকে সবসময় নিজের সন্তানসম আগলে রাখতেন। জিয়ার পরিবারের সাথে তৌহিদ স্যার এবং আমার পারিবারিক পর্যায়ে সুসম্পর্ক ছিল। এরপরও জিয়া কী করে পারলো তার অধিনায়ককে টেনে হিঁচড়ে গ্রেফতার করে নির্যাতন করতে?? স্যার যথেস্ট কঠোর মানসিকতার ছিলেন, নির্যাতন সয়ে যাচ্ছিলেন কিন্তু স্যারের মত কঠোর মানুষটাকে তার পরিবারের উপর আসন্ন নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে তিনি কোনদিন বিএনপির রাজনীতির সাথে জরিত হবেন না এই মর্মে মুচলেকা দিয়ে তার কাঁধের উপর ক্রিমিনাল চার্জের মামলা ঝুলিয়ে তাকে এ পর্যন্ত নিস্কৃয় করে রেখেছে জিয়া।
সত্য সমাগত মিথ্যা বিতাড়িত।
প্রসঙ্গত, এর আগে মোস্তাফিজুর রহমান লেখালেখি করেছেন বাংলাদেশের সাবেক সেনা প্রধানক নিয়ে।সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ এর সাথে তার সম্পর্কের কথা নিয়ে অনেক কিছুই লিখেছিলেন তিনি। তার সেই সব লেখনী পাঠক মহলে হয়েছিল বেশ জনপ্রিয় ।