চলমান আন্দোলন শান্তিপূর্ণ পথে রেখে সরকারকে ‘বড় ধাক্কা’ দিতে চায় বিএনপি। এ কারণে কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তিন দিক থেকে সরকারকে নীরবে কাবু করার কৌশল নিয়েছে দলটি। এরই অংশ হিসেবে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছে। যেখানে ভোট বর্জনসহ পাঁচ দফা দিয়ে তা পালনের আহ্বান জানানো হয়। জনসমর্থন বৃদ্ধির মাধ্যমে কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে তারা দেশব্যাপী ব্যাপক গণযোগাযোগ ও লিফলেট বিতরণ করছেন। দেশের বাইরেও এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়েছে। রাজপথে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি থাকবে। ভোটের দিনসহ পাঁচ দিনের জন্য জনসাধারণের কারফিউ দেওয়ার চিন্তাভাবনাও রয়েছে। এসব কর্মসূচিতে শরিকদের সমর্থন পাওয়ায় আন্দোলন সফল হবে বলে আশা করছে দলটি। একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
নেতারা আরও বলেন, অনেক পর্যালোচনা ও নীতিনির্ধারকদের পরামর্শ ও আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার পর অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। তাদের পিঠ দেয়ালে লেগে আছে। সে কারণে এ আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না। পাঁচ দফা বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। তবে তা বাস্তবায়নে দেশের পাশাপাশি বিদেশেও ব্যাপক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এতটুকু বলা যায়, অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে।
তারা আরও বলেন, ২৮ অক্টোবরের পর প্রথমবারের মতো গণসংযোগকে কেন্দ্র করে প্রায় সব সাংগঠনিক জেলায় নেতাকর্মীরা মাঠে নামতে পেরেছেন। গত দুই দিনে ৬০ লাখ লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। একই পথে থাকা সমমনা ব্যক্তিদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর তৎপরতাও বেড়েছে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর সব সংগঠিত থানায় লিফলেট বিতরণ করেছে জামায়াত। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারাও নিজ নিজ এলাকা থেকে গণসংযোগে অংশ নিচ্ছেন। যার কারণে নেতাকর্মীদের আগের চেয়ে বেশি উদ্যমী দেখা যাচ্ছে। যা ভবিষ্যতের কর্মসূচিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিএনপির রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এই বিষয়ে ফলপ্রসূতার আশা দেখছেন।
সূত্র জানায়, আগামীকাল রোববার সকাল-সন্ধ্যা অবরোধ কর্মসূচি রয়েছে। একদিনের বিরতি দিয়ে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত হরতাল বা অবরোধ ও গণসংযোগ কর্মসূচির পরিকল্পনা করা হয়েছে। এরপর আবার আন্দোলনের ধরন বদলানোর কথা ভাবছে বিএনপি। যার মধ্যে ৩ জানুয়ারি থেকে ৭ জানুয়ারি ভোটের দিন পর্যন্ত ‘পাবলিক কারফিউ’ দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। অসহযোগিতার ক্ষেত্রে ‘পাবলিক কারফিউ’ জারি করা যেতে পারে। যেখানে লোকজনকে বাড়ি থেকে বের না হতে, প্রাইভেট কার ও পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বন্ধ করতে এবং সরকারি ও বেসরকারি অফিস বন্ধ করতে বলা হতে পারে। নতুন বছরের শুরুতে এ কর্মসূচির ডাক আসতে পারে। এ ছাড়া বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা দলগুলো ওই সময় সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নামবে বলে ইতিমধ্যেই আলোচনা হয়েছে। নির্বাচন বর্জনকারী অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও আলাদাভাবে কর্মসূচি পালন করবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, “বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের চলমান আন্দোলনে অসহযোগের ঘোষণা নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করেছে যে বিএনপি একটি উদারপন্থী রাজনৈতিক দল। যারা ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে প্রতিবাদ ও আন্দোলন পরিচালনা করে এবং সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করে। শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়া।এই বাগ্মী সরকার দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গভীর নৈরাজ্যের অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছে।এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় দেশকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনা।আর সেই লক্ষ্যেই বিএনপি এগোচ্ছে। অসহযোগের মন্ত্রে সরকার সূচনা করে দেশের আঠারো কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছে। বিএনপি বিশ্বাস করে দেশবাসীর কাছে এই আবেদন সরকারকে সংঘাতের পথ ছেড়ে দিয়ে পথ প্রশস্ত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ।
তিনি আরও বলেন, ‘একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমেই এ দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসতে পারে, যার জন্য আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। যা অর্জনে আজ রাজপথে নেমেছে বিএনপির প্রতিটি নেতাকর্মী। বিএনপির জন্য নয়, কোনো ব্যক্তির জন্য নয়, এদেশের সকল মানুষের মৌলিক ভোটাধিকারের পাশাপাশি সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অর্থনৈতিক অধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের রাজপথের আন্দোলন চলবে।
বিএনপির বিরুদ্ধে ’৯৬ সালে অসহযোগের মধ্যেই হরতাল, ঘেরাও ও অবরোধের মতো কর্মসূচি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলো ওই কর্মসূচি পালন করে। ২৭ বছর পর এবার বিএনপি ও জামায়াত সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারেরই পুনর্বহালের দাবিতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একই কর্মসূচি দিয়েছে। সরকারকে কোনো ধরনের সহযোগিতা না করতে বিএনপি বুধবার এ আন্দোলনের ডাক দেয়। প্রশাসন, দেশবাসী ও দলীয় নেতাকর্মীদের ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জন, নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনে বিরত থাকা, সরকারকে কর, খাজনা, ইউটিলিটি বিল স্থগিত রাখা, ব্যাংকে টাকা জমা না রাখা, রাজনৈতিক মামলায় নেতাকর্মীদের আদালতে হাজিরা দেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে দলটি।
বিএনপি মনে করে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এ অবস্থায় বাংলাদেশের এবারের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক দেখতে চেয়েছে গণতান্ত্রিক বিশ্ব। বিএনপি, বাম ও ইসলামপন্থি অন্তত ৬৩ দল নির্বাচন বর্জন করেছে। ফলে এবারের নির্বাচনও দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে কিনা, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন আছে। এটি সরকারকে আরও বেশি কূটনৈতিক চাপে ফেলবে। পাশাপাশি দেশে অর্থনৈতিক সংকটও রয়েছে। এরপরও বিরোধী নেতাকর্মী ও সমর্থক যারা প্রবাসে থাকে তারা যদি অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন করে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ রাখে, তাহলে চলমান ডলার সংকট আরও বাড়বে। দেশের অভ্যন্তরে দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের কিছু অংশও যদি ট্যাক্স এবং ইউটিলিটি বিল দেওয়া থেকে বিরত থাকেন, তাহলে অর্থনৈতিকভাবে সরকারের ওপর চাপ আরও বাড়বে।
দলটির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, সারাদেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এক লাখ ৩৮ হাজারের বেশি মামলায় প্রায় ৫০ লাখ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। এই নেতাকর্মীরা অসহযোগ আন্দোলনে সমর্থন জানাতে আদালতে না গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হবে। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আন্দোলন ও নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করবেন, নাকি নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করবেন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষে একই সঙ্গে দুটি কাজ করা সম্ভব হবে না। তাছাড়া বর্তমানে বিএনপির ২৩ হাজারের বেশি নেতাকর্মী কারাগারে রয়েছেন। সেখানে বন্দীর সংখ্যা এখন ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ। এ অবস্থায় সরকার আরও নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে কোথায় রাখবে? সব মিলিয়ে বিএনপির অসহযোগ আন্দোলন সরকারকে নতুন করে কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে ফেলবে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাছুম বলেন, সরকারের বাধা-নিপীড়ন সত্ত্বেও জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জনগণের মতামত বিবেচনা না করে সরকার প্রহসনের নির্বাচন আয়োজন করেছে তা জনগণ মেনে নেবে না।
যদিও বিএনপির একাংশ ও সমমনা ব্যক্তিরাও মনে করছেন, বাস্তবতার আলোকে কর, ফি, ইউটিলিটি বিল দেওয়া বন্ধ, আদালতে মামলায় হাজিরা না দেওয়া, ব্যাংকে টাকা না রাখার আহ্বান বাস্তবায়ন করা কঠিন হতে পারে। প্রতীকী অর্থে সরকারকে ‘অসহযোগ’ করার পরিকল্পনা থেকে এ কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। এতে সরকারের ওপর যেমন চাপ সৃষ্টি হবে, জনগণও নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করবে। জনগণ সচেতন হলে সরকারের বিরুদ্ধে নানাভাবে অসহযোগিতার ভূমিকা পালন করতে পারে বলে মনে করেন তারা।