Wednesday , December 25 2024
Breaking News
Home / Countrywide / কোন ভাবে শেষ হবে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন

কোন ভাবে শেষ হবে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন

গত কয়েক ধাপে জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিছুটা হলেও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারী হতে জুনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার নিয়ম রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার জন্য সকল ধরনের কৌশল ও পদ্ধতি অবলম্বন করছে এবং সকল ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এতকিছুর পরেও নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কিনা সে বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েই যাচ্ছে অনেকের মনে। তবে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হবে এমনটা আশাবাদ ব্যক্ত করছেন বিশিষ্টজনেরা। নির্বাচন নিয়ে বদিউল আলম মজুমদার একটি নিবন্ধ সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত হয়েছে যৎা তুলে ধরা হলো-

গণতান্ত্রিক শাসন আমাদের সাংবিধানিক অঙ্গীকার। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র।” এছাড়াও, আমাদের সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদে প্রশাসনের সকল স্তরে জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক শাসনের অন্যতম পূর্বশর্ত। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার যাত্রা শুরু হয় নির্বাচনের মাধ্যমে, যাতে জনগণের সম্মতির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আমাদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ।

সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ ছাড়া নির্বাচনে সরকারের পাশাপাশি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাও অপরিসীম। উপরন্তু, সুশীল সমাজের সক্রিয়তা সুষ্ঠু বা বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে।

সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনকে চারটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যা হল: ১) রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচন, (২) সংসদ নির্বাচন, (৩) নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ এবং (৪) ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ। এসব কাজে কমিশনের দায়িত্ব ‘তত্ত্বাবধান, নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণ’। এসব দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের জন্য সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনকে একটি স্বাধীন সংস্থা হিসেবে গঠন করা হয়েছে। তাই বর্তমান আউয়াল কমিশন যদি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও সাহসিকতার সাথে সক্ষমতার পরিচয় দিয়ে কাজ করে তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ মসৃণ হবে।

উপরোক্ত চারটি দায়িত্ব পালনে নির্বাচন কমিশনকে অপরিসীম ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদের ‘তত্ত্বাবধান, নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণ’ ক্ষমতা ব্যাখ্যা করে, আলতাফ হোসেন বনাম আবুল কাসিমের মামলায় বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ নির্বাচন কমিশনের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা স্বীকার করে বলেছে যে, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থ সাধারণত একটি নির্বাচিত সংসদের জন্য নির্ধারিত হয়। এ ছাড়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ইসিকে অনেক ক্ষমতা দিয়েছে।

তবে বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়ে ইতিমধ্যেই নানা প্রশ্ন উঠেছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ আরও অনেক রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশন গঠনে অংশ নেয়নি। স্বচ্ছ নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন, ২০২২-এ বিধান থাকলেও বর্তমান কমিশনের স্বচ্ছতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। ফলে বর্তমান কমিশনের ওপর চরম আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে।

সাম্প্রতিক কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন, যা বর্তমান কমিশনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট কেস ছিল, তারা কতটা সক্ষম তা নিয়ে অনেকের মনেই সংশয় দেখা দিয়েছে। এই নির্বাচনে, কমিশন সিটি কর্পোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা, ২০১৬ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে। বিধির ২২ ধারার অধীনে, কমিশন স্থানীয় সংসদ সদস্যকে “সরকারি সুবিধাভোগী” হিসাবে এলাকা ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে একটি আদেশ জারি করেছে যাতে তিনি এমনকি শোনেনি। বিধিমালার ৩১ ও ৩২ ধারায় আচরণবিধি লঙ্ঘন ও প্রার্থিতা বাতিলের জন্য কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও নির্বাচন কমিশন তা কার্যকর করা থেকে বিরত থাকে। শুধু তাই নয়, মাননীয় সিইসি দাবি করেন, কোনো সংসদ সদস্য এভাবে আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেও তাদের কিছু করার নেই। এমনকি একজন নির্বাচন কমিশনারও বলেছেন, একজন সম্মানিত ব্যক্তিকে বদনাম করা কমিশনের কাজ নয়। নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল দাবি করেন, কমিশন এমপিকে নির্বাচনী এলাকা ছেড়ে যেতে বলেনি। এসব অসামঞ্জস্যপূর্ণ বক্তব্য শুধু একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে জনসম্মুখে হেয় প্রতিপন্ন করেছে তাই নয়, কমিশনের সদস্যরাও নিয়ম-কানুন প্রয়োগে অক্ষমতার কারণে আইনানুযায়ী ও সরল বিশ্বাসে তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন।

একটি ছোট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ক্ষেত্রে, নির্বাচন কমিশন তাদের নির্বাচনী বিধি প্রয়োগে অপারগতা দেখালে একজন সংসদ সদস্যের জাতীয় নির্বাচন পরিচালনার ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা স্বাভাবিক। কারণ, জাতীয় নির্বাচনে সংসদ সদস্য থাকবেন তিনশ’। সেখানে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাও থাকবেন, যাদের বিরুদ্ধে অতীতে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া এতে সব রাজনৈতিক দলের কয়েক হাজার প্রার্থী ও অগণিত নেতাকর্মী থাকবেন। কুমিল্লায় মাত্র একজন সংসদ সদস্যের আত্মসমর্পণের প্রেক্ষাপটে জাতীয় নির্বাচনে এত শক্তিশালী দলকে বর্তমান কমিশন কীভাবে সামলাবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তাই আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে কি না তা নিয়ে রয়েছে নানা ভয়।

আগামী নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে উদ্বেগের আরেকটি কারণ হলো ইভিএম। ইভিএম ব্যবহার করে ভোটকেন্দ্রে ডা”কাতদের কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু ইভিএমের ক্ষেত্রে আরও অনেক ডাকাত নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কেন্দ্রের প্রিজাইডিং বা পোলিং কর্মকর্তারা তাদের ইভিএম ওভাররাইড করার ক্ষমতা ব্যবহার করে ফলাফল পরিবর্তন করতে পারেন। যারা ইভিএম প্রোগ্রামিংয়ের সাথে জড়িত তারাও কা’রসাজি করতে পারে। একজন ম্যাজিস্ট্রেট বলেছেন, অন্তত একটি কেন্দ্রে কারচুপির অভিযোগে কুমিল্লার নির্বাচন বিঘ্নিত হয়েছে। সর্বোপরি, ইভিএমকে ছাপানোর ক্ষমতা বাড়িয়ে কমিশন নির্বাচনী ফলাফলেও প্রভাব ফেলতে পারে। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত জাতীয় নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র কর্মকর্তাদের ২৫ শতাংশ ইভিএম ওভাররাইড করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। এসব কারণে ইভিএম ব্যবহারে ডিজিটাল জালিয়াতির সম্ভাবনা রয়েছে।

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সর্বশেষ যে চারটি কেন্দ্র থেকে ফলাফল এসেছে, সেগুলো খতিয়ে দেখতে হবে ইভিএম ডাকা”তদের হাতে গেছে কিনা। ভোট শেষ হতে না হতেই ইভিএম থেকে ফলাফল পাওয়ার কথা থাকলেও চারটি কেন্দ্র থেকে ফল পেতে চার ঘণ্টা দেরি হলো কেন? এবং এই চারটি কেন্দ্রের ফলাফলের সাথে, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী অলৌকিকভাবে ৩৪৩ ভোটে জয়ী হয়েছেন, যদিও তিনি আগের ১০১টি আসনে ৬২৯ ভোটে পিছিয়ে ছিলেন। পরাজিত প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু জোর করে হারানোর অভিযোগ তুলেছেন। গত চারটি কেন্দ্রের ফল প্রকাশে বিলম্বের বিষয়টি কমিশন যখন নানাভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে তখন এই নাটক আরও প্রশ্ন তোলে। কুমিল্লার ফলাফলে নাটকীয় পরিবর্তন নিয়ে বিতর্ক নিরসনের একমাত্র উপায় নিরপেক্ষ তদন্ত। কিন্তু কমিশন সে পথে হাঁটেনি।

আবার ইভিএমে ভোটার ভেরিফাইয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপিএটি) নেই, যার দুর্বলতার কারণে প্রয়াত ডাঃ জামিলুর রেজা চৌধুরী এই ইভিএম কেনার সুপারিশে স্বাক্ষর করেননি। আর এই দুর্বলতার কারণে মনিরুল হকের কোনো অভিযোগই সত্য বা মিথ্যা প্রমাণ করা যাচ্ছে না। কারণ, VVPAT ছাড়া ইভিএমে ভোট পুনঃগণনা বা অডিটের কোনো সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে কমিশনের দেওয়া ফলাফলই চূড়ান্ত।

এসব দুর্বলতার পাশাপাশি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করে। উদাহরণস্বরূপ, যেমন, ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে যে ২৯৪টি আসনে ব্যালট পেপার ব্যবহৃত হয়েছিল, তাতে ভোট পড়ার হার ছিল ৮০ দশমিক ৮০ শতাংশ, তার বিপরীতে ইভিএম ব্যবহৃত ছয়টি আসনে ভোট পড়ার হার ছিল প্রায় ৩০ শতাংশ কম। এমনকি কুমিল্লা সিটি নির্বাচনেও ২০১৭ সালের তুলনায় এবার ভোট পড়ার হার প্রায় ৫ শতাংশ কমেছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন এই ইভিএম ব্যবহারে বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে।

ইভিএমে এসব দুর্বলতা এবং কমিশনের নিজস্ব কাঠামোর প্রতি বিরোধী দলের আস্থাহীনতা এবং আইন প্রয়োগে অক্ষমতা আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য হবে কিনা তা নিয়ে অনেকের মনেই গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচনের সময় যদি সরকার, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরপেক্ষ আচরণ না করে, রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে সরকারি দলগুলো ভালো আচরণ না করে এবং গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ যদি সঠিকভাবে মনিটরিং না করে, তাহলেআশা দুরাশাই থেকে যাবে। যদি এই দুরাশার অবসান না হয় এবং ২০২৩ সালের শেষের দিকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হয়, তাহলে জাতি হিসাবে আমরা একটি বিপর্যয়ের দিকে যেতে পারি।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন যদি জনগণের না হয় সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন রয়ে যাবে। নির্বাচন কোন ব্যক্তি বিশেষের নয় এটা সংবিধান অনুযায়ী দেশের সকল নাগরিকের। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়া অতি জরুরী। জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইভিএম মেশিন দেওয়া হলেও প্রশ্ন থাকতে পারে, আবার এদিকে ব্যালট হলে সেখানেও কারচুপি ঘটতে পারে- তাই ইসিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন প্রক্রিয়ায় নির্বাচন অধিকতর সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে।

About bisso Jit

Check Also

শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে নয়াদিল্লির জবাব, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পৌষ মাস নাকি সর্বনাশ?

ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মন্তব্য করেছে। নয়াদিল্লি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *