বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর বেশিদিন বাকি নেই। মানুষ প্রস্তুতি নিচ্ছে ভোট ডেবার জন্য। বিশেষ করে যারা নতুন ভোটার তারা অনেক আনন্দ অনুভব করে। কেননা জীবনের প্রথম জাতীয় ভোট দিতে যাচ্ছে। সম্প্রতি জানা গেছে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সক্রিয় বিদেশি কূটনীতিকরা। তারা খুব কাছ থেকেই নজর রাখছেন।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নানা তৎপরতা শুরু করেছেন বিদেশি কূটনীতিকরা। ঢাকায় নিয়োজিত বিভিন্ন মিশনের রাষ্ট্রদূতরা সরকারের মন্ত্রী, নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছেন। তাদের আলোচনায় উঠে আসছে নির্বাচনের প্রসঙ্গ। এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারাও বিদেশি কূটনীতিকদের আন্দোলন নিয়ে কথা বলছেন। তাদের অভিযোগ, ‘বিদেশিদের কাছে ধরনা’ দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে রাজনৈতিক অত্যাচারের বহিঃপ্রকাশ। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ‘কোনো শক্তিশালী দেশের কিছু করার নেই’ বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তবে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বিদেশিদের এই কর্মকাণ্ড নিয়ে বিরোধী মত প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশের বিগত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নির্বাচনের এক থেকে দেড় বছর আগে থেকেই বিভিন্ন বিদেশি রাষ্ট্রদূত নানা তৎপরতা শুরু করেন। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক ও নির্বাচনী বিষয়ে আলোচনা। প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকদেরও রাজনীতিবিদদের সৌজন্যে নৈশভোজের আয়োজন করতে দেখা যায়। এবারও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দেড় বছর আগে সেই তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের পর কূটনীতিকদের তৎপরতা জোরদার হয়েছে।
বর্তমান কমিশন গঠনের পর যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ৮ জুন ইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ২৬ জুন অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার জেরেমি ব্রুয়ারের সঙ্গে দেখা হয়। এরপর ৩ জুলাই ১৪টি দেশের রাষ্ট্রদূতরা একসঙ্গে ইসিতে যান। সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ডেনমার্ক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, স্পেন, তুরস্ক এবং জাপানের ৩৮টি দেশের রাষ্ট্রদূতদের নেতৃত্বে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (ওইসিডি) অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের হাইকমিশন। এই তিন বৈঠকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বৈঠকে তারা বলেন, আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু দেখতে চান। এ কারণে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতার আশ্বাসও দেন তারা।
এদিকে গত ৭ জুন ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে বলেন, “আগামী বছরের শেষের দিকে নির্বাচন হওয়ার কথা। গণমাধ্যম প্রতিদিনই এই নির্বাচন নিয়ে খবর প্রচার করছে। এ বিষয়ে নির্বাচনে আমি সরকারের কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ লক্ষ্য করেছি।আশা করি সরকার গতবারের চেয়ে ভালো, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য পদক্ষেপ নেবে।’ তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে তারা ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন।
১৩ জুলাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি এবং জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক জিন লুইস গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে গিয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে দেখা করেন। তবে দুই বৈঠকের বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানায়নি বিএনপি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
এর আগে গত ১৭ মার্চ জার্মান রাষ্ট্রদূত আখিম ট্রোস্টারের সঙ্গে দেখা করেন বিএনপি নেতারা। তবে ওই বৈঠকের আলোচনাকে বিএনপি নেতারা ভুলভাবে উপস্থাপন করেছেন বলে আরেকটি অনুষ্ঠানে ক্ষোভ প্রকাশ করেন জার্মান রাষ্ট্রদূত।
এদিকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ডা.হাছান মাহমুদ বলেছেন, বিএনপি সব সময় বিদেশীদের কাছে দৌড়ায়। তাদের ভিড় বিদেশী রাষ্ট্রদূতের কাছে, বিভিন্ন বিদেশী সংস্থার কাছে। তবে এ দেশের মালিক দেশের জনগণ, তারাই প্রতিনিধি নির্বাচন করবে। কোনো বিদেশি রাষ্ট্রদূত বা কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধির ক্ষমতায় কাউকে ভোট দেওয়ার অধিকার নেই।
হাসান বলেন, আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ করা ঠিক নয়। কিন্তু তারা নাক কামড়াতে না চাইলেও বিএনপিকে তাদের কাছে নাক ডাকতে দেখি। এটা দেশকে সংকুচিত করার শামিল। আমি বিএনপিকে অনুরোধ করবো বিদেশীদের কাছে না গিয়ে জনগণের কাছে যেতে। এটা বিএনপির জন্য ভালো হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘বিএনপি যতই বিদেশীদের সাথে কথা বলুক না কেন; এটা কোন ভাল কাজ করবে না. যুক্তরাষ্ট্র যত শক্তিশালীই হোক না কেন, বাংলাদেশের নির্বাচনের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বিদেশিদের সঙ্গে আলোচনা কাম্য নয়। দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় সংক্রান্ত যেকোনো সমস্যা আমরা নিজেরাই সমাধান করতে পারি। আর আমি না পারলে কোনো বিদেশি এসে সমাধান করতে পারবে না। বিদেশীদের কাছে ধর্না রাজনৈতিক কাপুরুষতার বহিঃপ্রকাশ।
ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। একই দিন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করেন নবনিযুক্ত ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াটলি। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বাইরের কেউ যেন কথা না বলে। অন্য কোনো দেশের নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করার দায়িত্ব আমার নয়। হয়তো আমরা কিছু বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারি।’
বিশ্বের অনেক দেশেই নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে উল্লেখ করে তাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশে নির্বাচন বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। যে দেশগুলি অন্যদের তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অনুমতি দেয় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের নাগরিক হিসেবে দেশের মানুষ কারো নাকে হাত দিতে পছন্দ করে না, করবেও না।
বিএনপিকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জনগণের কাছে জনপ্রিয় না হওয়ায় শেষ আশ্রয় হিসেবে বিদেশিদের কাছে ধর্না দিচ্ছে। ক্ষমতা পাওয়ার জন্য তারা দেশকে হেয় প্রতিপন্ন করছে। কোন বিদেশী তাদের ক্ষমতায় বসাতে পারবে না। সেই ক্ষমতাও তাদের নেই।
তিনি বলেন, বিদেশিদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে কূটনৈতিক সম্পর্ক। এই সম্পর্কটা আমাদের রাখতে হবে। কিন্তু আমি যদি তাদের আমার বাড়ির কথা বলি, তারা আমার পরিবারকে দেখে নাক সিঁটকাবে। অন্য কথায়, আমরা বিদেশীদের আমার বাড়িতে এসে মাতাল হওয়া সম্ভব করে দিচ্ছি।
ডা: শাম্মী বলেন, অনেক দেশের নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা শোনা যায়, কিন্তু বাংলাদেশ কী নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছে? তাহলে আমাদের দেশের কথা বলছেন কেন? তারা কেন আমাদের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে চায় বা কাজ করতে চায়?
কূটনীতিকদের এমন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘তারা আমাদের অতিথি। আমরা তাদের সম্মান করি। তবে অতিথিদেরও একটি সীমানা থাকা উচিত। কতটা সীমানা অতিক্রম করবে বা করবে না। কিন্তু আমরা তাদের এই সীমানা অতিক্রম করার সুযোগ দিচ্ছি। আপনি যদি তাদের কাছে নিজেকে ছোট আকারে উপস্থাপন করেন তবে তারা আপনার মাথায় চড়তে চাইবে। কিন্তু বাংলাদেশ এখন কারও পরামর্শ নেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। আমাদের কোন দরদ নেই। কোনো দুর্বলতা নেই।’
ইসির সঙ্গে সাক্ষাতের প্রশ্নে তিনি বলেন, “তারা অতিথি হয়ে নির্বাচন কমিশনে গিয়েছিলেন। আর অতিথির সঙ্গে দুর্ব্যবহার করবেন না, এটাই স্বাভাবিক। যোগাযোগ করা হলে তারা অবশ্যই তাদের কর্মকাণ্ড ব্যাখ্যা করতে পারে। কেন নির্বাচন কমিশন স্পষ্ট করতে পারেনি? বলুন যে আমরা একটি স্বাধীন সংগঠন।আমরা জানি আমাদের কি করতে হবে।তারা কেন পারেনি তা ব্যাখ্যা করতে পারবে।
নির্বাচন ইস্যুতে বিদেশিদের তৎপরতা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশেদ উজ জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, স্বাধীন সার্বভৌম দেশে বিদেশিদের এ ধরনের কর্মকাণ্ড গ্রহণযোগ্য ও কাম্য নয়। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমি এটাকে স্বাগত জানাই না।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের চেয়ে বিভিন্ন দেশে বড় সমস্যা রয়েছে। আমাদের নির্বাচন আইন ও সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই হয়। তারপরও কোনো সমস্যা হলে তা দেশের জনগণই সমাধান করবে। আমি মনে করি বিদেশিদের এ ধরনের হস্তক্ষেপ সম্পর্কে সকল নাগরিকের সচেতন হওয়া উচিত। তাদের কোনো ধরনের পদক্ষেপকে স্বাগত জানানো উচিত নয়।
প্রফেসর এম শহীদুজ্জামান বলেন, “ভোট আসতে এখনো দেড় বছর বাকি” এবং এর মধ্যেই গঙ্গার পানি অনেক দূর প্রবাহিত হবে। কূটনীতিকরা সবসময় এই কার্যকলাপ দেখেছেন এবং তা অব্যাহত থাকবে। আমরা দেখতে পাচ্ছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখানে অনেক আগ্রহ দেখাচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেখাচ্ছে, হয়তো ভারতও দেখাচ্ছে। আমাদের নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার কথা বলা হলেও তা হচ্ছে না। আর তারা না এলে আবারও একই অবস্থা হবে। এখানে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কূটনীতিকরা কোনো উদ্যোগ নিলে এটা ভালো লক্ষণ। যদিও সরকার এটা খুব একটা পছন্দ করে বলে মনে হয় না।
প্রসঙ্গত, প্রত্যেকবারের মত দেশে সুষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক এমনটাই প্রত্যাশা করেন সাধারণ জনগন। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দ্বারা দেশে আবারো আসবে যোগ্য ও দক্ষ নেতা যিনি দক্ষ হাতে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন সমৃদ্ধির দিকে।