আইএমএফের কাছে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে কয়েকটি শর্ত বেধে দিয়েছিল। তার মধ্যে ছিল, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও সারে ভর্তুকি তুলে নেয়া। এর মধ্যে সারের দাম বাড়িয়েছে সরকার। তেলের দাম বাড়াল গড়ে ৪৫-৫০ শতাংশ (যদিও পেট্রলে ভর্তুকি নেই, এটা দেশে উৎপাদন হয়), বিদ্যুতের দাম বাড়াবে, কারণ দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় মানে বিইআরসির গণশুনানি শেষ। গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হবে।
আইএমএফের সব কথা শোনা দেশগুলো সব সময় তলানিতে থাকে। না শোনা দেশগুলোর বিরুদ্ধে কথিত গণতন্ত্র বিরোধীতার অভিযোগ করলেও তাদের নিজেদের একটা পজিশন থাকে।
আইএমএফ’র বেলআউট প্রগ্রামে আদৌ কোনো দেশ পতন থেকে উঠে দাড়িয়েছে বলে জানা নেই। বরং এটা হলো সেই হেমলক যা সক্রেটিসকে খাওয়ানো হয়েছিল। যা পান করলে ফেরার সুযোগ থাকে না।
শ্রীলঙ্কার শেষ পেরেকটা কিন্তু মেরেছে আইএমএফ। খোজ নিয়ে দেখুন। সেখানে যে বিদেশী ঋণ আছে তার মধ্যে চীনা ঋণ ১০%, বিশ্বব্যাংকের ৯%, এডিবির ১৩%, জাপানি ১০%। ভারত ২%, মার্কেট থেকে বন্ড ছেড়ে ৪৭%, অন্যান্য ৯%। সব মিলিয়ে ৫১ বিলিয়ন ঋণ।
এই প্রবণতার মধ্যে ভারতের মিডিয়া বেছে বেছে শুধু চীনা ঋণের কারণে ডুবেছে সেই গল্প ফাদছে।
১.
সকলপ্রকার জ্বালানি পন্যর মূল্যনিয়ন্ত্রক সংস্থা একমাত্র বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। ফলে কোনভাবে নির্বাহী আদেশে আমলারা জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর এখতিয়ার রাখে না। এটা ফৌজদারি অপরাধ, শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
২. বিপিসি গত সাত বছরে ৪৭ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম তখন সস্তা ছিল। লাভের সময় মাত্র একবার ২০১৬ সালে লিটারপ্রতি খুব সামান্য টাকা কমিয়েছিল সরকার। সেটা বলার মত না। লাভের ৪৭ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৮ হাজার কোটি টাকা সরকার নিয়ে গেছে। বাকি ৩৯ হাজার কোটি টাকাতো বিপিসির হাতে আছে।
ধরেও যদি নেই যে, আমরা লোকসানে আছি, তাহলে ৩৯ হাজার কোটি টাকাতো বিপিসির হাতে ছিল। সেই টাকা এখন লোকসানিতে ব্যয় করা যেতো।
৩. আন্তর্জাতিক বাজারে গত ছয় মাসের মধ্যে সর্বনিন্ম অবস্থায় আছে জ্বালানি তেলের দাম। অপরিশোধিক বিট্রিশ ব্যারেন্ট প্রতি ব্যারেল নেমেছে ৯৫ ডলারে যা উঠেছিল ১২৮ ডলার পর্যন্ত। তেলের দাম পড়ার সময় এভাবে বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।
৪. সরকার গড়ে প্রতি লিটার ডিজেল, কোরোসিন, অকেটন ও পেট্রোলে ১৩ থেকে ১৮ শতাংশ কর নেয়। সরকার বছরে ২২ হাজার কোটি টাকার বেশি তেল কেনে। এর মধ্যে শুধু কর নেয় প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। করশূণ্য করলেইতো দাম বাড়ানো লাগে না। সরকার বেসরকারি বহু পন্যকে করমুক্ত করেছে। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকরা তেল আমদানি করলে কর দিতে হয় না। তো?
৫. বুঝলাম বিদেশে তেলের বাজার বাড়তি। সে কারণে নিজের দেশের জনগনের ওপর সব চাপানো হবে। কিন্তু পেট্রলতো বিদেশ থেকে আমদানি করা হয় না। দেশে যে ২ লাখ টনের বেশি পেট্রলের দরকার হয় তার ১০০ ভাগই দেশের গ্যাসক্ষেত্রের কনডেনসেট থেকে উৎপাদিত হয়। তো, পেট্রলের দাম কেন বাড়বে? এক লিটার পেট্রল উৎপাদনে বড়জোর ৫০ টাকার মত খরচ। তাহলে এক লিটার পেট্রল বিক্রি করে সরকার এখন ৮০ টাকা লাভ করবে? তাহলে দুই লাখ টন পেট্রলে সরকারের বছরে কত লাভ হবে আপনারা হিসাব করেন। অকটেনের ৬০ শতাংশ আমদানি করে বুস্টার নামে, সেটা দেশে উৎপাদিত অকটেনের সাথে মিশিয়ে বিক্রি করে। তাহলেও অকটেনের দাম লিটার প্রতি ৪৬ টাকা কিভাবে বাড়ে? পৃথিবীর কোথাও এক ধাক্কায় কখনো সরকারি কোনো পন্যর দাম ৫১ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব?
৬. আজকে আমেরিকায় পেট্রলের লিটারপ্রতি দাম ১১২ টাকা, আর ব্লক স্টেট নামে পরিচিত, যাদের কনডেনসেট নেই গ্যাস , তাদের নিজেদের পেট্রল বানানোর সুযোগ নেই সেই ভুটানে আজকে প্রতি লিটার পেট্রলের দাম ১২০ টাকা।
আমাদের অর্থনীতি ভুটানের চেয়ে খারাপ আর আমেরিকার চেয়ে ভালো-আমি এটা বুঝলাম। আপনারা কি বুঝলেন?
তবে যারা IFM, World Bank, ADB কে পাত্তা দেয় না এমন দেশ, ধরেন আপনাদের ভাষায় ফকিরা সেই ভেনেজুয়েলাতে আজকে প্রতি লিটার পেট্রলের দাম দুই টাকা ও ইরানে পাঁচ টাকা।
আমার পরিচিত দুজন পাঠাও চালক জানিয়েছেন, তাদের জ্বালানি খরচ বাড়বে ৫০ শতাংশ। কিন্তু তাদের যারা গ্রাহক বা কাস্টমার তারা কি সেই অর্থ দিতে প্রস্তুত? এসব নিয়ে তারা চিন্তিত।
ভাবুন সারা দেশের ব্যষ্টিক অর্থনীতি বা ক্ষুদ্র অর্থনীতি ও সামষ্টিক অর্থনীতি বা বৃহৎ অর্থনীতি দুটোরই পশ্চাতদেশ লাল হয়ে যাবে। কারণ জ্বালানি তেলের কারণে সবকিছুর উৎপাদন খরচ বাড়বে।
এর ফলে সবকিছুর দাম বেড়ে যাবে। দাম বেড়ে গেলে গরিব ও নিন্ম আয়ের মানুষের আয় বাড়বে না। কিন্তু ব্যয় বাড়বে। ব্যয় বাড়লে তারা সবকিছু কেনাকাটা কমিয়ে দেবে, ডজ মুডে বা মিনিমাম খরচ মুডে গিয়ে সারভাইব করার চেষ্টা করবে। এতে কী হবে?
এতে যা হবে তাহলো, ধনিদের কারখানার উৎপাদিত পণ্য বেহুদা বেকার বসে থাকবে। সেগুলো বিক্রি হবে না। তার ফলে ধনিরা তাদের কারখানার পন্য উৎপাদন কমিয়ে প্রথমে সারভাইব করার চেষ্টা করবে। তাতেও তারা পারবে না। তখন তারা শ্রমিক ছাটাই করবে। শ্রমিক ছাটাই করলে বাজারে পন্য কেনা আরও কমবে। এতে গোটা উৎপাদন খাত আরও বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। তখন ধনিরা সরকারের কাছে তাদের লোকসান থামাতে বেলআউট প্রগ্রাম চাইবে।
আমার প্রশ্ন ডেকে ডেকে এমন একটা অর্থনৈতিক মন্দা কেন আনার দরকার ছিল? আইএফএফের ৪.৫ বিলিয়ন ডলারের জন্য এতো কান্নাকাটির কি দরকার ছিল? এসব অসংখ্য প্রশ্নের জবাব বাস্তবে মাঠে দেবার কথা ছিল রাজনীতিবিদ ও দলগুলোর। কিন্তু তাহারা ক্ষমতার জন্য বসে আছে। কখন দেশ শ্রীলঙ্কা হয়। কিন্তু মনে রাখবেন যে শ্রীলঙ্কা হবার জন্য আপনারা দোয়া দুরুদ পড়তেছেন সেই শ্রীলঙ্কায় পেট্রলের দাম আপনার থেকে বা বাংলাদেশ থেকে মাত্র ১২ টাকা বেশি। মানে আর ১২ টাকা হলে আমরা শ্রীলঙ্কাকে ছুয়ে ফেলব।