বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের দুটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে দুই নারী কেবিন ক্রু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম-জেদ্দা এবং ঢাকা-মাসকট-ঢাকা রুটের এই ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটি ও এভিয়েশন সেক্টরে তীব্র আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ভুক্তভোগী ক্রুরা বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. সাফিকুর রহমান বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন।
ভিযোগের পরপরই বিমানের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি অভিযুক্ত ও অভিযোগকারী দু’পক্ষের শুনানি করছে। তদন্ত কমিটি বলছে, যদি অভিযোগের সত্যতা মিলে তবে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এভিয়েশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে এর আগেও অনেক নারী কেবিন ক্রু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। বেশির ভাগ ঘটনায় বিমানের পাইলটদের সম্পৃক্ততা মিলেছে। ককপিটের মতো সুরক্ষিত জায়গায় নারী সহকর্মীদের যৌন হয়রানির ঘটনা বিমানের ভাবমূর্তি রক্ষায় ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। বিষয়গুলো জানাজানির পর অন্য নারী কেবিন ক্রু’রাও চিন্তিত। এ ছাড়া যৌন হয়রানির পরও অনেক কেবিন ক্রু মুখ খুলেন না। কারণ মুখ খুললে তাদের চাকরি নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। পাইলটদের আধিপত্য চাকরি হারানোর শঙ্কায় থাকেন তারা। তাই অনেকে নীরবে এসব হয়রানি মেনে নেন। প্রতিবাদ করার সাহসও পান না।
বিমান সূত্র জানায়, গত ১৪ই নভেম্বর বিমানের সিইও বরাবর এক পাইলটের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি এবং অপেশাদারমূলক আচরণের অভিযোগ করেন ফ্লাইট সার্ভিস উপ-বিভাগের এক কেবিন ক্রু। ওই অভিযোগে বলা হয়, গত ১০ই নভেম্বর বিজি-১৩৫ নম্বর ফ্লাইট (ঢাকা- চট্টগ্রাম- জেদ্দা) অপারেট করেন ওই নারী কেবিন ক্রু। এই ফ্লাইটে অপারেটিং পাইলট ছিলেন মুনতাসীর ও আবেদ। ফ্লাইটের মাঝামাঝি সময় তারা ওই নারী কেবিন ক্রুকে ককপিটে ডাকেন। কুশল বিনিময়ের একপর্যায়ে পাইলট আবেদ তার সঙ্গে অপেশাদারমূলক (ব্যক্তিগত) কথাবার্তা বলেন।
পরবর্তীতে ককপিট দরজার সামনে তাকে একা পেয়ে জোরপূর্বক হ্যান্ডশেক করতে চান পাইলট আবেদ। পরে গত ১২ই নভেম্বর ফিরতি ফ্লাইটে (বিজি-২৩৬ জেদ্দা-সিলেট-ঢাকা) এই কেবিন ক্রুর ‘ওয়ার্কিং পজিশন’ ছিল সামনে। কাজের জন্য তাকে বেশ কয়েকবার ককপিটে যেতে হয়েছে। তখন পাইলট আবেদ কৌতুক শোনানোর ছলে তাকে বাংলা ব্যাকরণ (কারক, সমাস, লিঙ্গ পরিবর্তন) নিয়ে কথা বলেন। একপর্যায়ে আবেদ লিঙ্গ পরিবর্তন এবং নাড়াচাড়া করলে ধাতু বের হবে এই রকম কুরুচিপূর্ণ এবং অশ্লীল মন্তব্য করেছেন। একপর্যায়ে পাইলট আবেদ নানা রকম কুরুচিপূর্ণ এবং অশ্লীল মন্তব্য করেন। এ ছাড়া নোংরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করেন। ওই দিন রাতেই বিমানের এমডি ও সিইও বরাবর ইমেইলে পাইলট আবেদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন ওই নারী কেবিন ক্রু।
বিমান সূত্র জানায়, গত ৩রা নভেম্বর ঢাকা থেকে মাসকটগামী বিজি ৭২১ নম্বর ফ্লাইট ছেড়ে যায়। এই ফ্লাইটের পাইলট ছিলেন ইউসুফ মাহমুদ। তিনিও এক নারী কেবিন ক্রুকে ককপিটে ডেকে যৌন হয়রানি করেন। এ ঘটনায় গত ৭ই নভেম্বর বিমানের এমডি ও সিইও বরাবর অভিযোগ দিয়েছেন ওই নারী কেবিন ক্রু। লিখিত অভিযোগে ওই নারী জানান, মাসকটগামী ফ্লাইটে পাইলট ইউসুফ ওই নারী কর্মীকে ককপিটে ডেকে নিয়ে তার শরীর স্পর্শ করেন এবং জোর করে কমলা খাইয়ে দেন।
এর আগে ২০১৯ সালে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ১০ জন পাইলটের বিরুদ্ধে ককপিটে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তুলেছেন একাধিক নারী কেবিন ক্রু। বিমানের জ্যেষ্ঠ পাইলট ইশরাত আহমেদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে তখন এসব তথ্য বেরিয়ে আসে। তবে এসব ঘটনায় দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়নি বিমান। অথচ বিমানের ককপিটে পাইলটের সব সময় ফ্লাইট পরিচালনায় সতর্ক থাকতে হয়। অথচ সেখানে ওই ধরনের যৌন হয়রানির ঘটনা দুঃখজনক বলে মনে করেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা। আকাশপথে এই ধরনের কর্মকাণ্ড খুবই বিপজ্জনক।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ উইং কমান্ডার এটিএম নজরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, আমি মনে করি এটার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। কারণ এরকম পরিবেশ হলে মেয়েরা কীভাবে কাজ করবে? সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে ছেলে-মেয়ে সবারই কাজ করার অধিকার আছে। অভিযোগ মিথ্যা হতে পারে তবে সঠিকভাবে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করতে হবে। অভিযোগ সত্য হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া উচিত। এ ছাড়া এ ধরনের ঘটনা কেন ঘটছে, কীভাবে ঘটছে এবং এটি কীভাবে বন্ধ করা যায় সেটা দেখতে হবে। প্রয়োজনে ক্যামেরা বসিয়ে দিতে হবে। তিনি বলেন, আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। কিছু ক্ষেত্রে সত্যতাও মিলেছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে সত্যতা মিলেনি।
মূল বিষয় হচ্ছে এসব ঘটনার কোনো প্রমাণ থাকে না। আমার কাছেও অনেক অভিযোগ আসছে। অনেক পাইলটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। মাসকটগামী ফ্লাইটের ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান ও বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) বোসরা ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, যৌন হয়নারির ওই অভিযোগ নিয়ে তদন্ত চলছে। শুনানি পর্যায়ে আছে। দু’পক্ষের শুনানি করা হচ্ছে। আমরা বিষয়টিকে খুবই সিরিয়াসলি দেখছি। আশাকরি খুব দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারবো।
এ ধরনের ঘটনা বিমানের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং কর্মীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। সংশ্লিষ্ট মহল অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।