একটি কিংবা দুইটি বাড়ি নয়, ১৪টিরও বেশি বাড়ি রয়েছে বাংলাদেশের এক কর্মকর্তার! তবে সেটা বাংলাদেশে নয়, সুদূর স্বপ্নের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে। আর এই কর্মকর্তা হলেন ঢাকা ওয়াসার এমডি প্রকৌশলী তাকসিম এ খান, তিনি অনেকটা কৌশলে এই সম্পদ গড়ে তুলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি শহরে। ঐ শহরগুলোতে তার সেই বাড়িগুলো বেশ জৌলুস নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই সকল বাড়িতেই হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। দেশ থেকে বিপুল পরিমান টাকা পাচার করার মাধ্যমে তিনি এই সকল বাড়ির মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বাড়ি কেনার অর্থের উৎস ও লেনদেন প্রক্রিয়ার তথ্য খুঁজতে শুরু করেছে ইন্টারপোলসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। দেশটির গোয়েন্দা নজরদারিতে তাকসিমকে বেশ কয়েকটি বড় বাড়ি কেনার ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে তালিকায় তার নাম উঠে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ১৪টি বাড়ি ক্রয় এবং অর্থপাচারকারী হিসেবে আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় তাকসিম খানের নাম অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে সম্প্রতি দুটি অভিযোগ করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযোগে কোনো কোনো বাড়ির সুনির্দিষ্ট ঠিকানা, ছবি, কোন বাড়ি, কবে, কত টাকায় কেনা হয়েছে তা উল্লেখ করা হয়েছে। অভিযোগের সঙ্গে তাকসিমকে নিয়ে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) ‘গভর্নমেন্ট ওয়াচ নোটিশ’-এর একটি অনুলিপি সংযুক্ত করা হয়েছে।
নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ (ডিওজে), ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই), দেশের অন্যান্য সংস্থা এবং ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন (ইন্টারপোল) সিআইএ সহ তাকসিম এ খানকে নিয়ে কাজ করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা দেশের একটি জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ২০০৯ সাল থেকে ১৩ বছরে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির টাকায় তাকসিম যুক্তরাষ্ট্রে একের পর এক বাড়ি কিনেছেন। তার কিছু প্রমান ইতিমধ্যে সংগ্রহ করা হয়েছে। বাকিদের তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।
তাকসিমের যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি-গাড়িসহ প্রচুর সম্পদ থাকলেও দেশে তার কোনো সম্পদ নেই। গুলশান-২ এর ৫৫ নম্বর সড়কের সরকারি বাসভবনে তিনি থাকেন না। তিনি থাকেন নয়াপল্টনে, শ্বশুরবাড়িতে।
যুক্তরাষ্ট্রে ১৪টি বাড়ি: সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি নিয়ে দুদকের কাছে যে দুইজনের অভিযোগ জমা পড়েছে, তাদের একজন হলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি মো. সোহেল রানা। অভিযোগ খতিয়ে দেখতে কমিশনকে অনুরোধ করেন তিনি।
দুদকে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়, তাকসিম হুন্ডিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে বৈদেশিক ঋণ নিয়ে ওয়াসার বড় প্রকল্প থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেন। নগদ ডলার দিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেস, নিউইয়র্কসহ দেশটির অভিজাত এলাকায় ১৪টি বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, তাকসিম যুক্তরাষ্ট্রেরও নাগরিক। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালীন ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার এমডি হিসেবে যোগদান করেন। তার পরিবারের সবাই মার্কিন প্রবাসী। তাকসিমও প্রতি বছর প্রায় তিন মাস যুক্তরাষ্ট্রে পরিবারের সঙ্গে থাকেন। একসময়ের ভাড়াটিয়া তাকসিম লস অ্যাঞ্জেলেসের মতো অভিজাত শহরে বিলাসবহুল বাড়ি কেনেন। এ খবর ওই শহরের বাঙালিপাড়ার লোকজনের মুখে মুখে শোনা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রবাসী বাঙালি বলেন, প্রবাসী বাঙালিদের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে তাকসিমের বাড়ি দেখেছেন। তারা জানে কোন শহরে কোন বাড়ি, কোন রাস্তা, হোল্ডিং নম্বর- সব তথ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে ১৪টি বাড়ির মধ্যে পাঁচটি খুঁজে পাওয়া গেছে। ওই সব বাড়ির ঠিকানা ও ছবি দেশের একটি জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যমের কাছে রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত এক বাঙালি তাকসিমের ওই পাঁচটি বাড়ির ঠিকানা জানান।
যুক্তরাষ্ট্রে পরিবার-পরিজন নিয়ে তাকসিম যে বাড়িতে থাকেন, সেটার ঠিকানা- 531, N Louise St. Unit 302, Glendale, CA 91206। এই বাড়ি তিনি কত টাকায় কিনেছেন, তা জানা যায়নি। এ ছাড়া 419, E Cypress Avenue Burbank, CA 91501- এ ঠিকানায় ২০১৭ সালে ১৯ লাখ ৭৬ হাজার ৮৮৯ ডলারে (সে সময়ের দরে আনুমানিক ১৭ কোটি টাকা) কেনা বাড়িটিতে রয়েছে ১৪টি বেডরুম ও ১৪টি বাথরুম। 518, Salem Street Glendale, CA 91203- এই ঠিকানায় ২০১৮ সালের আগস্টে ৪৩ লাখ ৯৮ হাজার ৪৭৪ ডলারে (আনুমানিক ৩৭ কোটি টাকা) কেনা বাড়িটিতে রয়েছে ছয়টি বেডরুম ও ছয়টি বাথরুম। 350 E 30th Street New York, NY 10016-8386- এই ঠিকানায় ২০১৭ সালের জুলাইয়ে ৬ কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৬১৪ ডলারে (আনুমানিক ৫৩৫ কোটি টাকা) কেনা বাড়িটিতে রয়েছে ১০২টি বেডরুম ও ১০২টি বাথরুম। 3555 Kystone Avenue Los Angels, CA 90034- এই ঠিকানায় ২০১৯ সালের অক্টোবরে ৮২ লাখ ৭৫ হাজার ৯৮০ ডলারে (আনুমানিক ৭০ কোটি টাকা) কেনা বাড়িটিতে রয়েছে ১২টি বেডরুম ও ১২টি বাথরুম। বাড়িগুলো তাকসিন ভাড়া দিয়ে রেখেছেন।
আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় নাম: বিপুল পরিমাণ অর্থের উৎস ও লেনদেনের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থা সন্দেহভাজন তালিকায় তাকসিমকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। লস অ্যাঞ্জেলেস, নিউইয়র্কসহ বিভিন্ন শহরে বিলাসবহুল বাড়ি কেনার বিষয়টি খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। ১৪টি বাড়ি কেনার বিপরীতে অর্থ কোথা থেকে এসেছে তা দেখছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়া এই প্রবাসী বাঙালি নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকে অভিযোগ করে বলেন, তিনি ওয়াসায় ঠিকাদার হিসেবে কাজ করতেন। এ সময় তিনি দেখেন, তাকসিম ঢাকা ওয়াসা কীভাবে বড় প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ করে যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করেছে। দুর্নীতি অনেক প্রকল্পের কার্যকারিতা ধ্বং”/স করেছে। তিনি এ তথ্য প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনতে ব্যর্থ হন। তিনি তাকসিমের বিরুদ্ধে দুদকে প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনতে অভিযোগ জমা দেন।
দুদকের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দুদকের কাছে ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের নামে দুটি অভিযোগ এসেছে, যুক্তরাষ্ট্রে তার ১৪টি বাড়ি রয়েছে এবং সন্দেহভাজন হিসেবে তার নাম রয়েছে। দেশের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় তার নাম রয়েছে। দুদক আইনে অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় নাম থাকার বিষয়ে সম্প্রতি ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। এ বিষয়ে কথা বলতে চাওয়ার জন্য বৃহস্পতিবার এমডি মাকসুদুর রহমানের যিনি ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) হিসেবে রয়েছেন তার নিকট কল করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাওয়া হয়।কিণ্তু পিএ এ বিষয়ে বলেন, ‘স্যারের সাথে দেখা করতে হলে আজ আর হবে না। স্যার একটি মিটিংয়ে রয়েছেন। তবে কবে কথা বলা যাবে এমন জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, সেটা স্যারের সাথে কথা বলে পরে জানাতে পারবো।