শাহবাগ থানায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দুই কেন্দ্রীয় নেতাকে পিটিয়ে আহত করার ঘটনায় অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (বর্তমানে এপিবিএন-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার) হারুন-অর-রশিদের উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্রলীগ নেতারা। দোষীদের বিচার নিশ্চিত করতে রাজপথে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গণমাধ্যমকে বলেন, দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার অভাব দেখলে ছাত্রলীগ কর্মসূচি দেবে।
এদিকে এডিসি হারুনের কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে ছাত্রদলও। ছাত্রলীগের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল শাখাও তার শাস্তির জন্য বিবৃতি দিয়েছে। তবে এ ঘটনায় ছাত্রলীগের ‘নিরব’ ভূমিকায়ও হতাশা প্রকাশ করেছে সংগঠনটি।
শনিবার (৯ সেপ্টেম্বর) রাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও ফজলুল হক হলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন নাঈম এবং কেন্দ্রীয় বৈজ্ঞানিক বিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। এডিসি হারুন এ ঘটনায় ছাত্রলীগ-ছাত্রদল উভয় সংগঠন হারুন-অর-রশিদের বিচার দাবি করেছে।
ছাত্রলীগের বিক্ষোভ, আন্দোলনের হুঁশিয়ারি
রোববার (১০ সেপ্টেম্বর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগ এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. মেহেদী হাসান শান্ত ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেও আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শনিবার রাতে পুলিশের রমনা বিভাগের এডিসি হারুন-অর-রশিদের নেতৃত্বে ওই দুই ছাত্রলীগ নেতাকে শাহবাগ থানায় নিয়ে গিয়ে অমানবিক ও নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগ পুলিশের এই পৈশাচিক কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, বঙ্গবন্ধু হল শাখা ছাত্রলীগ সবসময় বাংলাদেশ পুলিশের মতো মহান পেশাকে সম্মান করে। কিন্তু যারা এই মহান পেশাকে কলুষিত করতে চায় তারাই দেশের শত্রু। একই সঙ্গে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া না হলে এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে রাজপথে কঠোর আন্দোলন করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল শাখা ছাত্রলীগও একই দাবি করেছে। হল শাখা ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক সাব্বির রহমান শুভ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, এই নিন্দনীয় ঘটনার সাথে জড়িত সকলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কামনা করছি এবং একই সাথে আমাদের অভিভাবক শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিচার দাবি করছি।
এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগও এ বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। হল শাখার সভাপতি মো. আজহারুল ইসলাম মামুন ও সাধারণ সম্পাদক হাসিবুল হোসেন শান্তর স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এডিসি হারুনের বিচারের দাবিতে রাজপথে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
প্রয়োজনে কর্মসূচি দেবে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ
পুলিশের হাতে ছাত্রলীগের দুই নেতার বেড়ধক মারধরের শিকার হওয়ার ঘটনায় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেছেন, এ ঘটনায় যথাযথ কর্তৃপক্ষের আশু পদক্ষেপ নিতে আন্তরিকতার ঘাটতি দেখা গেলে আমরা কর্মসূচি দিতে পারি। আমরা যদি দেখি আইনি প্রক্রিয়ায় সঠিকভাবে তার বিচার হচ্ছে বা কাজ হচ্ছে, তাহলে আমাদের কিছু করা ঠিক নয়।
রোববার সন্ধ্যায় গণমাধ্যমে শেখ ইনান এ সব কথা বলেন। এ ঘটনায় মামলা করবেন কি না— জানতে চাইলে শেখ ইনান বলেন, ‘আইনি বিষয়ে কতটুকু কী করা যায়, আমরা খতিয়ে দেখছি।’
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘বিষয়টি খুবই দুঃখজনক, লজ্জাজনক। বাংলাদেশ পুলিশ শিক্ষার্থীবান্ধব, সন্ত্রাস নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের পক্ষে কাজ করে। সেক্ষেত্রে পুলিশের এমন বিচ্ছিন্ন কর্মকর্তার কাজ পুরো বাহিনীর জন্য লজ্জাজনক। এ বিষয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের অনুরোধ জানাই।’
ইনান বলেন, ‘আমরা স্বরাষ্টমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। উনি আমাদের কাছ থেকে ঘটনার বিবরণ শুনে তাৎক্ষণিক এডিসি হারুনকে স্ট্যান্ড রিলিজ দিয়েছেন। পুলিশকে বিভাগীয় তদন্তের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। পুলিশ কমিশনার জানিয়েছেন, তারা বিভাগীয় তদন্ত শুরু করেছেন। অর্থাৎ বাংলাদেশ পুলিশও এ বিষয়ে বদ্ধপরিকর। তারা অপরাধকে প্রশ্রয় দিতে ইচ্ছুক নয়।’
যদিও পরে সন্ধ্যায় এডিসি হারুনকে নতুন করে পদায়ন করা হয়েছে। ডিএমপি থেকে দুপুরর দিকে হারুন-অর-রশিদকে রমনা জোন থেকে প্রত্যাহার করে সংযুক্ত করা হয়েছিল পুলিশের পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট বিভাগে। পরে সন্ধ্যায় পুলিশ সদর দফতর থেকে এক প্রজ্ঞাপনে তাকে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে।
বিবৃতি দিয়েছে ছাত্রদলও
ছাত্রলীগের দুই নেতাকে বেড়ধক পেটানোর ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতিতে দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল। রোববার ঢাবি ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদক মো. মাহমুদুল হাসানের পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, ছাত্রলীগের মতো একটি পুরনো ছাত্রসংগঠনের এমন অমর্যাদাকর অবস্থানের কারণে ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি খোরশেদ আলম সোহেল ও সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম নিন্দা ও হতাশা প্রকাশ করেছেন। দুই ছাত্রলীগ নেতাকে নির্যাতনসহ অতীতের সব পুলিশি নির্যাতনের দায়ে এডিসি হারুনকে বিচারের আওতায় আনার দাবিও জানিয়েছেন তারা।
এ ঘটনায় অবশ্য ছাত্রলীগেরও কঠোর সমালোচনা করেছেন ছাত্রদলের শীর্ষ দুই নেতা।বিবৃতিতে বলা হয়, আজ তাদের দুজন কেন্দ্রীয় নেতা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরও ছাত্রলীগের কেউ কোনো প্রতিবাদ জানাতে সক্ষম হয়নি। এতেই বোঝা যায়, ছাত্রলীগ এখন নীতি-আদর্শহীন একটি দেউলিয়া সংগঠনে পরিণত হয়েছে। একজন পুলিশ কর্মকর্তার ভয়ে সমগ্র বাংলাদেশের ছাত্রলীগ তটস্থ। ওই পুলিশ কর্মকর্তা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডযোগ্য অপরাধ করার পরও আইনি কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার ন্যূনতম সাহস ছাত্রলীগ নেতারা দেখাতে পারেননি। তারাও জানেন, পুলিশের সঙ্গে মিলেমিশে পুলিশি রাষ্ট্রে তারা যে মাৎস্যন্যায় প্রতিষ্ঠা করেছে, তাতে তাদেরও বিচার পাওয়ার কোনো সুযোগ অবশিষ্ট নেই।
আরও বলা হয়, গত ১৫ বছর ধরে পুলিশের সহায়তায় সারাদেশে ক্যাম্পাসে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে ছাত্রলীগ। তারা ছাত্রদলসহ সব বিরোধী ছাত্র সংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়। নির্যাতিত মুমুর্শু শিক্ষার্থীদের পুলিশের হাতে তুলে দেন। গায়েবি মামলায় পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে আবার নির্যাতন চালায়। বিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর অমানবিক পুলিশি নির্যাতনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা উল্লাসে মেতে ওঠেন। পুলিশ বাহিনী ভোট কারচুপির দায় নিলেও ছাত্রলীগের নেতারা রাজনীতি ছেড়ে টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হয়েছেন। ছাত্রলীগের সমালোচনা করলেও বিবৃতিতে এডিসি হারুনকে বিচারের আওতায় আনার জোর দাবি জানিয়েছে ছাত্রদল।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক সদস্যরা
এদিকে থানা ছাত্রলীগের দুই কেন্দ্রীয় নেতাকে মারধরের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছেন ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতারা। তারা এডিসি হারুনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আল আমিন রহমান লিখেছেন, আমরা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বন্ধু আনোয়ার হোসেন নাঈমের পাশে আছি। সবাই তার সুস্থতার জন্য দোয়া করবেন। একজন সাইকোপ্যাথ ছাড়া আর কেউ এমন কাজ করতে পারেনি।
ছাত্রলীগের শাখা সম্পাদক মনির হোসেন লিখেছেন, এডিসি হারুন একজন সন্ত্রাসী। বারবার অপরাধ করার পর সাহস বেড়েছে। ঢাকা কলেজ অনেক শিক্ষার্থীর জীবন নষ্ট করেছে। তার বিচার না হলে আমি থামব না।
আহত নাঈমের ছবি শেয়ার করে ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি ইয়াজ আল রিয়াদ লিখেছেন, “আমার ছাত্রলীগের ছোট ভাই। আমি জানতে চাই কেন এমন হলো, কেন হলো। এটা মেনে নেওয়ার মতো ঘটনা!
ছাত্রলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক ইন্দ্রনীল দেব শর্মা রনি লিখেছেন, আনোয়ার হোসেন নাঈম ও শরীফ আহমেদ মুনিমের বর্বরতার দ্রুত শাস্তি হওয়া উচিত।
প্রধানমন্ত্রীর সাবেক প্রেস সেক্রেটারি আশরাফুল আলম খোকন লিখেছেন, ‘আমাদের গাজীপুরের যে কয়টা ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে, এর মধ্যে আনোয়ার হোসেন নাইমকে আমরা বলি সবচেয়ে ভদ্র, মার্জিত ও মিষ্টি হাসির একটা ছেলে। সে কারও সাথে বেয়াদবি করেছে কিংবা উচ্চস্বরে কথা বলেছে, এমন কথাও কেউ বলতে পারবে না।
‘নাইম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ফজলুল হক হল ছাত্রলীগের সভাপতি। একজন পুলিশ অফিসারের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় তার ওপর যে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে, তা ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। প্রতিবাদ করারও ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। পুলিশের ইমেজ নষ্ট করার জন্যই এই রকম একজন কর্মকর্তাই যথেষ্ট। নাঈমের জন্য শুভ কামনা…,’— লিখেছেন আশরাফুল আলম খোকন।
সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী তিলোত্তমা শিকদার লিখেছেন, ‘ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার। সব নিয়ে নীতি কী শুধু ছাত্রলীগের জন্য..? আমার ভাই নাইম-মুনিমের পাশে আছি।
ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাসিবুল হোসেন শান্ত লিখেছেন, ‘এডিসি হারুন একটা সন্ত্রাসী। ঢাকা কলেজের ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো, কনস্টেবলকে থাপ্পড় মারা, সুপ্রিম কোর্টে সাংবাদিক পেটানো আর আজ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের দুই নেতার ওপর বর্বর অত্যাচার যা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। হারুনের অব্যাহতি চাই।’
‘হারুনকে শাস্তি পেতেই হবে’
শাহবাগ থানায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দুই কেন্দ্রীয় নেতাকে পিটিয়ে আহত করার ঘটনায় অভিযুক্ত হারুন-অর-রশিদকে শাস্তি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। রোববার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস ঢাকা পূর্ব (আফতাবনগর) ও ঢাকা পশ্চিম (মোহাম্মদপুর) এবং পাসপোর্ট অফিস (কল সেন্টার) উদ্বোধন অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যে এটা করেছে, সে পুলিশ হোক বা যেই হোক, অন্যায় করলে শাস্তি পেতে হবে। এটা কেন করলো, কী করেছিল, আমরা জিজ্ঞাসা করব। তাকে তার ভুল কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
এডিসি হারুনের বিরুদ্ধে এর আগেও মারধরের অভিযোগ ছিল- এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, গতকালের ঘটনাটি প্রথম উল্লেখযোগ্যভাবে এসেছে, আমরা একটু দেখে নিই। আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। সে যতখানি অন্যায় করেছে ততখানি শাস্তি সে পাবে।