পড়া-শুনা মানুষের জীবনের সব থেকে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। আর এটাই অনেক সময় হয়ে ওঠে না অনেক মানুষের জীবনে।দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে অনেকেই ছিটকে পড়েন জীবনের গুরুত্বপূর্ন এবং মধুর সময় থেকে। আবার অনেকেই এসব জয় করে নেন নিজের ইচ্ছাশক্তির জোড়ে।এমনই এক জলজ্যান্ত উদাহারন সৃ্ষ্টি করলেন সরোয়ার নামের এই যুবক। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি বাবাকে চায়ের দোকানে সহযোগিতা করে আসছেন। লেখাপড়া শেষ করে দিনের পুরো সময় বাবার চায়ের দোকানে কাজ করছেন। চা বানিয়ে নিজেই পরিবেশন করছেন। এমনকি চায়ের দোকানে কাজের পাশাপাশি তিনি টিউশনও করেন। শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতিও নেন।
তবে সেই প্রস্তুতিটা নিয়েছেন চায়ের দোকানে বসেই। বাড়িতে পড়ালেখার উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় দোকান বন্ধের পর সেখানে বসেই শুরু করেন চাকরির পড়াশোনা। প্রতিদিন দুপুর ও রাতে পড়া শেষ করেই ফেরেন বাড়ি। এভাবেই এনটিআরসিএ কর্তৃক শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
সারোয়ারের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বারোঘরিয়া ইউনিয়নের কাজীপাড়া গ্রামে। তার বাবা মো. শাহজাহান আলীর ৩২ বছর ধরে বারোঘরিয়া বাজারে চায়ের দোকান রয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) বাংলাদেশে বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৫৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগের ফল প্রকাশ করে। ওই ফলাফল অনুযায়ী, সারোয়ার জাহান সাঞ্জু বগুড়ার গাবতলী উপজেলার সৈয়দ আহম্মদ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রভাষক হিসেবে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।
জন্ম থেকেই দারিদ্র্যতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে সারোয়ার জাহানকে। চার ভাই-বোনের মধ্যে সারোয়ার বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। বারোঘরিয়া ৩৭ নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ২০০১ সালে পঞ্চম শ্রেণি পাস করেন। এরপর চামাগ্রাম হেনা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০৬ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন তিনি। এতে নিজ বিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথম ছাত্র হিসেবে জিপিএ-৫ পান সাঞ্জু।
মাধ্যমিক (এসএসসি) পরীক্ষায় নিজ বিদ্যালয় থেকে প্রথম ছাত্র হিসেবে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। ২০০৮ সালে নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্ব দেখান তিনি। এইচএসসি পাসের পর দেশের সেরা ও র্যাংকিংয়ের এক নম্বর রাজশাহী সরকারি কলেজের রয়াসন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেন। দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় টিউশন করে ব্যাপক সুনাম রয়েছে। এতকিছুর পরও সারোয়ার জাহান সাঞ্জু তার এলাকায় চায়ের দোকানদার হিসেবেই পরিচিত।
সারোয়ার বলেন, আমার জীবনে কষ্টের অভাব ছিল না, চারদিকে ছিল শুধুই অন্ধকার। ছোটবেলায় ভালোভাবে খেতে পাইনি। নোংরা জামা-কাপড় পরে ঘুরে বেরিয়েছি, তবুও কখনো নিজের পড়াশোনা বন্ধ করিনি। বারোঘরিয়া বাজারে সরকারি জায়গায় এক চালা দেওয়া বাবার চায়ের দোকান। ২০০১ সালে ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় থেকেই চায়ের দোকানে বাবাকে কাজে সহযোগিতা করতে থাকি। স্কুল-কলেজে যাওয়া ছাড়া বাকি সময় কাটত চায়ের দোকানে। ২০০৮ সাল পর্যন্ত এভাবেই চলে।
এইচএসসি পাসের পর রাজশাহী কলেজে ভর্তি হলেও সেখানে থেকে ক্লাস করা হয়নি। ফজরের সময় বের হয়ে রাজশাহীতে ক্লাস শেষে বিকেল ৩টার মধ্যে বাড়িতে ফিরতে হতো। চায়ের দোকানের পাশাপাশি চলতে থাকে টিউশন। ২০১৬ সালে মাস্টার্স শেষ হওয়ার পর পুরো সময় চায়ের দোকানে কাজ করি। ফজরের সময় দোকান খুলে ১০টা পর্যন্ত যা উপার্জন হয়, তা দিয়ে চাল-ডাল, তরকারি কিনে বাবা বাসায় চলে যান। কারণ মা অসুস্থ থাকায় বাবাকেই রান্না করতে হয়।
তিনি আরো বলেন, সকাল ১০টায় বাবা যাওয়ার পর দোকান বন্ধ করে চাকরির পড়া শুরু করি। দুপুর একটা নাগাদ বাসায় চলে যাই। আবার বিকেলে এসে রাত ৮টায় দোকান বন্ধ করে বাবা বাসায় যাই। আমি সে সময় দোকানে বসেই রাত ১১টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত পড়ি। তারপর বাসায় যায়। বন্ধ দোকানে পড়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাসায় অনেক লোকজন ও পড়ার উপযুক্ত কোনো পরিবেশ ছিল না। তাই দোকানে বসেই পড়ি। বাড়িতে এক দিনের জন্যও পড়া হয়নি।
পড়াশোনার পাশাপাশি দোকান চালিয়ে ছোট দুই বোনকে বিয়ে দিয়েছি। ছোট ভাই নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের মানবিক বিভাগে প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করছে। নিয়োগপ্রাপ্তির খবরে আমার থেকে বাবা-মা বেশি খুশি হয়েছে। আল্লাহর অশেষ কৃপায় জায়নামাজে থাকা অবস্থায় মাকে এই খুশির খবরটি দিতে পেরেছি।
রোববার রাতে সদ্য নিয়োগ পাওয়া এই প্রভাষকের সাথে কথা হয় তার সেই চায়ের দোকানেই। সে সময়ে তার চোখে মুখে ছিল বেশ উচ্ছ্বাস। বলছিলেন নিজের কথা।দোকানে কাজ করা অবস্থায় সারোয়ার জাহান আরো জানান, প্রভাষক হিসেবে নিয়োগেই আটকে থাকতে চাই না। শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় এখন আমার প্রধান লক্ষ্য।