কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত, স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু ও নিজাম উদ্দিন কায়সার দিনরাত তাদের নির্বাচনী প্রচারণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এই নির্বাচনী প্রচারণায় সাবেক মেয়র সাক্কুর সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের দেখা যাচ্ছে না। তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম, কমিশন বাণিজ্য, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যোগসাজশ এবং বিএনপি নেতাকর্মীদের হয়রানির অভিযোগ রয়েছে বলে স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে। এমনকি স্থানীয় সুত্রে এমনও শোনা যাচ্ছে সাবেক মেয়র সাক্কুর ভোটের ব্যাংক এখন এই নির্বাচনে অংশ গ্রহন করা আরেক প্রার্থী কায়ছারের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
বিএনপি ভোট বর্জন করার পরও দলের প্রধান অংশ সাক্কুর পেছনে। বাকি একাংশ আছে আরেক প্রার্থী নিজামউদ্দিন কায়সারের পক্ষে, যিনি স্বেচ্ছাসেবক দলের পদ ছেড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়েছেন। দৃশ্যত বলছেন জয়ের কথা, কিন্তু বলাবলি হচ্ছে, সাক্কুর পরাজয় নিশ্চিত করাই তার প্রধান লক্ষ্য। বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে ভোটে নেই। তবে পরোক্ষভাবে সেখানে লড়াই চলছে আওয়ামী লীগ-বিএনপিরই। এই সমীকরণে আবার একদিক থেকে ক্ষমতাসীন দল সুবিধাজনক অবস্থানে এ কারণে যে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে বিএনপিসংশ্লিষ্ট আছেন দুজন। কুমিল্লা শহর যখন ছিল পৌরসভা, তখনকার ভোটেও পারেনি আওয়ামী লীগ। সিটি করপোরেশন হওয়ার পর প্রথম ভোট ছিল দলীয় প্রতীক ছাড়া, তাতে হেরেছেন দল-সমর্থিত প্রার্থী, দ্বিতীয় ভোট ছিল দলীয় প্রতীকে, তাতেও আসে পরাজয়। টানা তিনবার জিতেছেন বিএনপি নেতা মনিরুল হক সাক্কু। এবার তার সামনে সিটি করপোরেশনে চতুর্থ জয়ের চ্যালেঞ্জ।
২০১২ সালের পর ২০১৭ সালে প্রার্থী পাল্টে ভোটের ব্যবধান ২৪ হাজার কমিয়ে ফেলতে পারে আওয়ামী লীগ। এবার বাজিমাতের আবার নতুন মুখ দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল। বিএনপি ভোট বর্জন করায় মনিরুল হক সাক্কুর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়াইয়ের বিকল্প ছিল না। তিনি করেছেনও তা। দল তাকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছে, কিন্তু দলের স্থানীয় নেতাকর্মী-সমর্থকদের বেশির ভাগের সমর্থন দৃশ্যত তার দিকেই। এটা শতভাগ নয়, এটিই সাক্কুর জন্য এবার বড় চ্যালেঞ্জ। বাকি একাংশ আছে আরেক প্রার্থী নিজামউদ্দিন কায়সারের পক্ষে, যিনি স্বেচ্ছাসেবক দলের পদ ছেড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়েছেন। দৃশ্যত বলছেন জয়ের কথা, কিন্তু বলাবলি হচ্ছে, সাক্কুর পরাজয় নিশ্চিত করাই তার প্রধান লক্ষ্য। কুমিল্লা শহরকে নিয়ে যে সংসদীয় আসন, সেটি ১৯৭৩ সালের পর প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের দখলে আসে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে। কিন্তু শহরের দখল এখনও নিতে পারেনি তারা। বিএনপিতে বিভেদের সুবিধা নিতে চায় তারা।
বিভেদ আওয়ামী লীগে নেই এমন নয়, তবে এবার অন্য দুবারের তুলনায় বেশি অপ্রকাশ্য। দল মনোনয়ন দিয়েছে সদর আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের অনুসারী আরফানুল হক রিফাতকে। বাহারের দ্বন্দ্ব ছিল অন্য যে বলয়ের সঙ্গে তার নেতা আফজল খান গত হয়েছেন গত বছর। এর পর থেকে আওয়ামী লীগ মূলত একই বৃত্তে। ১৫ জুনের এই ভোটে সাক্কু, রিফাত ও কায়সার- এই তিনটি নামই আলোচিত বেশি। অন্যান্য নির্বাচনে আলোচনায় থাকে আওয়ামী লীগের দুই বলয়ের মধ্যে সম্পর্ক কী হবে, এক বলয় অন্য বলয়কে হারাতে কাজ করবে নাকি দলের স্বার্থে এক হবে। এই আলোচনা এখন বিএনপিতে বেশি। সাক্কু ও তার বিরোধী বলয়ের ভূমিকা কী হবে, সেটিই জয়-পরাজয়ের নিয়ামক হয়ে উঠবে।কুমিল্লা মহানগরে বিএনপি দৃশ্যত দুই ভাগে বিভক্ত। এক অংশের নেতৃত্ব দেন সাক্কু, আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক সংসদ সদস্য আমিনুর রশীদ ইয়াসিন। এই ইয়াসিনের শ্যালক হলেন কায়সার। সাক্কু ও ইয়াসিনের বিরোধ কুমিল্লার মানুষজনের কাছে খুবই পরিচিত ইস্যু। দুই নেতার দ্বন্দ্বের কারণে দলীয় সভা আলাদা স্থানে হয়ে আসছে সেখানে।
কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো কর্মসূচির ডাক দেয়া হলে সাক্কুর অনুসারীরা দক্ষিণ জেলা বিএনপি অফিসে অবস্থা নেন। অন্যদিকে ইয়াসিন সমর্থকরা একত্রিত হন ধর্মসাগর পারে তার ব্যক্তিগত কার্যালয়ে। কায়সারের পাশে ইয়াসিন সমর্থকরা। তিনি লড়ছেন ঘোড়া প্রতীকে। তার মার্কায় যত ভোট পড়বে, সেটি নিঃসন্দেহে কাটা পড়বে সাক্কুর ঘড়ি প্রতীক থেকে। ভোটের প্রচারে নৌকার রিফাত যেভাবে সাক্কুর বিরুদ্ধে ব্যর্থতা ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলছেন, একই দলের নেতা হয়ে কায়সারও তাই করছেন। দুর্নীতি ও লুটপাটের বিরুদ্ধে তার বক্তব্য নিয়েও সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোচনা আছে।
এই প্রশ্নে মেয়র প্রার্থী অভিযোগ উগরে দিলেন সাক্কুর বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, ‘গত ১০ বছরে কুমিল্লা মহানগরের একাংশ ও সদর আসনের বহু নেতা-কর্মীর নামে অন্তত আড়াই শ মামলা হয়েছে। এই ১০-১২ বছরে মনিরুল হক সাক্কু ও তার নেতা-কর্মীদের কোনো মামলা হয়নি। উল্টো তিনি মেয়র থাকাকালীন আমাদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের লোকজন দিয়ে মামলা করিয়েছেন।
তার নেতা-কর্মী জেলে যাননি কেউ। মনিরুল হক সাক্কু এখন আওয়ামী লীগের লোক। তাই নেতা-কর্মীদের বাঁচাতে আমি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছি। তিনি বলেন, মনিরুল হক সাক্কু, আরফানুল হক রিফাত ও সদর আসনের সংসদ সদস্য এরা একই। তারা যে বলয় তৈরি করে নগরবাসীকে অত্যাচার-নির্যাতন করছে, লুটপাট করছে, কুমিল্লা নগরীতে একটি অকার্যকর নগরীতে পরিণত করেছে, তাদের এই বলয় ভেঙে কুমিল্লা নগরীতে একটি বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলতেই আমি মেয়র পদে নির্বাচন করছি। সব মিলিয়ে আমি আমার দলের নেতা-কর্মী এবং এই নগরবাসী চায় না মনিরুল হক সাক্কু আবার মেয়র হোক। পৌরসভা থাকাকালে একবার আর সিটি করপোরেশন হওয়ার পর দুবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে লড়াই করে সহজেই জয়ী হয়েছেন সাক্কু।
প্রতিবার তার পেছনে দল ছিল এককাট্টা। এবার নিজ দলের একাংশের বিরোধিতা নিয়ে তিনি কি চিন্তিত? তবে সাক্কু দাবি করেছেন, কায়সারকে তিনি গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তিনি বলেন, ‘কায়সার আমার ছোডু ভাই। তার শখ হইছে নির্বাচন করুক। তবে হেতের শখটা অইন্য জায়গায়। রাজনৈতিকভাবে আমার লগে না পাইরা এহন আইছে মেয়র ইলেকশন করত। আমার রাজনৈতিক অবস্থানডারে ভাঙতে আইছে। আমি হারলে আওয়ামী লীগের থাইক্কা লাভ বেশি তার। সে তো জানে না এই টাউনের লোকজন আমারে পছন্দ করে। ১৫ তারিখ বিজয়ের মালা আমার গলায় থাকব। মেয়র পদে অবশ্য আরও দুজন প্রার্থী আছেন। এরা হলেন ইসলামী আন্দোলনের হাতপাখা প্রতীকের রাশেদুল ইসলাম এবং সত্যিকার অর্থে দল নিরপেক্ষ কামরুল আহসান বাবুল, যার প্রতীক হরিণ। অবশ্য নির্বাচনে এই দুই প্রার্থী নিয়ে ভোটারদের মধ্যে তেমন কোনো আলোচনা নেই।
উল্লেখ্য, যে ভোটব্যাঙ্কের ভিত্তিতে সাক্কু গত দুই নির্বাচনে জিতেছে সেটি এখন অন্য আরেক প্রার্থী কাওছারের দিকে অগ্রসর হচ্ছে এমনটাই শোনা যাচ্ছে স্থানীয় পর্যায়ে। সাবেক মেয়র সাক্কু দিন দিন কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিকে পাশ কাটিয়ে বিজয়ী হতে নানা কৌশল অবলম্বন করছেন নৌকার প্রার্থী রিফাত। তবে আওয়ামী লীগের এক ডজন নেতাকে তার পাশে দেখা যাচ্ছে না।