রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি আগামী দিনে রাজনীতিতে কৌশলগত পরিবর্তন আসতে পারে। সরকার পতনের দীর্ঘদিনের আন্দোলনে কাঙ্খিত ফল না পাওয়ায় দলের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়গুলো এখন পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সরকারের পতন, নাকি সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিই মূল লক্ষ্য নির্ধারণ করা হবে, এ নিয়ে নানা মত রয়েছে। জানা গেছে, আগামীতে সরকার পতনকে মূল টার্গেট না করে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারে বিএনপি।
দলটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের পর আগামী দিনের রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে বিএনপির ভেতরে আলোচনা শুরু হয়েছে। দলটি বিশ্বাস করে যে গত নির্বাচনে ৯০% ভোটার ভোটদান থেকে বিরত ছিলেন। জনগণের এই আকাঙ্ক্ষাকে সামনে রেখেই এখন আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। বিএনপির বিকল্প নেই।
বিএনপি নেতারা বলেন, বিদ্যমান ‘একদলীয়’ রাষ্ট্রকাঠামোতে আন্দোলন করে সরকারকে পতন করা কঠিন কাজ। ১৯৯০ এর পর এ ধরনের কোনো আন্দোলন সফল হয়নি। নব্বই-এর আন্দোলনের সফলতার পেছনে যে ধরনের শক্তি এগিয়ে এসেছিল, আজ সেরকম কোনো বাস্তবতা নেই। সরকার রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে শাসন ক্ষমতা ধরে রেখেছে। এমন পরিস্থিতিতেও বিএনপি গত ১৫ বছর ধরে হামলা, মা”মলা, গ্রেফতার উপেক্ষা করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এখন আরও সুনির্দিষ্টভাবে আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাবে দলটি। আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হবে ভোট পদ্ধতির পরিবর্তন।
এ ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতিকে ঘিরে এশিয়ার পরাশক্তিগুলোর অবস্থান পর্যালোচনা করছে বিএনপি। ভারত, চীন ও রাশিয়া বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় আনতে সহায়তা করেছে বলে দলটি ইতিমধ্যে অভিযোগ করেছে। নির্বাচনের পর বিভিন্ন মহল থেকে ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাকও আসে। আগামী দিনে এসব পরাশক্তির সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের নীতি কী হবে তা নিয়ে ভাবছেন দলটির শীর্ষ নেতারা।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাবে বিএনপি। এর পাশাপাশি ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচি বাড়িয়ে ধীরে ধীরে রাজপথে শক্ত অবস্থান গড়ে তোলার চেষ্টা করা হবে। একই সঙ্গে দল পুনর্গঠনেও গুরুত্ব দিচ্ছেন নীতিনির্ধারকরা।
বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের সূত্র জানায়, পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি বুঝে তারা এগিয়ে যেতে চায়। অর্থাৎ যেকোনো কর্মসূচি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সতর্কতা অবলম্বন করা হবে। বিএনপি বলছে, জনগণের দাবি-আকাঙ্খা থেকে বিচ্যুত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই নির্বাচনের পর কয়েকদিন বিরতি দিয়ে সারাদেশে সব সাংগঠনিক পর্যায়ে কালো পতাকা মিছিল করা হয়েছে। তারা এ ধরনের প্রতিবাদ কর্মসূচির অংশ হতে চায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলেন, গত কয়েকদিনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির কোনো বৈঠক হয়নি। নতুন কর্মসূচির কথা ভাবছেন শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। আসন্ন পবিত্র রমজান মাসকে ঘিরে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে এখন একগুচ্ছ কর্মসূচি পালনের পরিকল্পনা রয়েছে।
দলীয় সূত্র জানায়, আগামীতে যুগপৎ আন্দোলনের পাশাপাশি দলীয় কর্মসূচিও পালন করবে বিএনপিসহ মিত্ররা। তবে ব্যাপক ভিত্তিতে নয়, স্বল্প পরিসরে থেমে থেমে কর্মসূচি দিয়ে যুগপৎ আন্দোলন চলবে। দিবসভিত্তিক কর্মসূচির সাথে বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধনের মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে আন্দোলন এগিয়ে নেবে বিএনপি ও শরিকরা।
শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের মূল্যায়ন, গত ৩০ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম কার্যদিবসে সারা দেশে কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে পুলিশের বাধার মুখে পড়েছেন তারা। এর আগে ২৬ ও ২৭ জানুয়ারিও কালো পতাকা কর্মসূচি পালন করে দলটি। সেখানেও বাধা দেয়া হয়েছে অনেক জায়গায়। এর মাধ্যমে নির্বাচন পরবর্তী সরকারের মনোভাব বুঝতে পেরেছেন তারা। তবে কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণে দলের নীতিনির্ধারকরা সন্তুষ্ট। সদ্য কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া নেতাকর্মীরাও এতে অংশ নেয়ায় দলে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে।
দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, তাদের মূল লক্ষ্য কারাবন্দি নেতাকর্মীদের জামিনে মুক্তি দেওয়া। তাই এখন সরকারকে কট্টরপন্থী করে এমন কোনো কর্মসূচি দিতে চায় না দলটি। দলটির স্থায়ী কমিটির এক নেতা বলেন, নির্বাচনে জয়ী হলেও সরকারের ভিত নড়ে গেছে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই নাজুক। সরকার অনেক চাপের মধ্যে আছে। এ অবস্থায় সরকারের অন্যায়ের প্রতিবাদ করে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে আছি। এ ধরনের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। রাজনৈতিক দল হিসেবে সরকারের অন্যায়ের প্রতিবাদ করব।
কয়েকদিনের মধ্যে দল পুনর্গঠনের কাজ শুরু হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিএনপি নেতারা। সেক্ষেত্রে জেলা পর্যায় থেকে সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ স্তরগুলো পুনর্গঠন করা হবে। যে নেতারা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন না, কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি- তাদের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় বাদ দেওয়া যেতে পারে। কারণ প্রাথমিক মূল্যায়নে দেখা যায়, সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিশেষ করে সাংগঠনিক কাজে নেতাদের ওপর ক্ষুব্ধ বিএনপির হাইকমান্ড।
অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো রাজপথে প্রত্যাশিত সক্ষমতা দেখাতে পারেনি বলে মনে করছে দলটি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন দায়িত্বশীল নেতা জানান, স্থায়ী কমিটি পুনর্গঠন নিয়ে আলোচনা চলছে। ছাত্রদলের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। তবে পুনর্গঠন ব্যাপক হবে কি না তা এখনো নিশ্চিত নয়।