‘মাহা বাজোয়া নামের ঐ নারী এখন আমার নেই। সে আমার সঙ্গে বড় ধরনের প্রতারণা করছে। আমি তাকে ১৯ মাস পূর্বে ডিভোর্স দিয়েছি’। হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলা পৌরসভার উত্তর বাজার বড়াইলের বাসিন্দা সাজ্জাদ হোসেন মজুমদার স্বামীর সন্ধানে বাংলাদেশে আসা পাকিস্তানি নারী মাহা বাজওয়ার প্রশ্নের জবাবে এমনটাই বলেন।
পাকিস্তানি নারী মাহা বাজওয়ার দাবি করা স্বামী সাজ্জাদ দুঃখের সঙ্গে কথাগুলো বলেছেন। বিবাহবিচ্ছেদের ১০ মাস পরে, তিনি মিডিয়ায় পাকিস্তানি মহিলা সম্পর্কে খবর প্রকাশ কারায় বিব্রত হন।
অসুস্থতার অজুহাতে মিডিয়াকর্মীদের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করছেন সাজ্জাদ হোসেন মজুমদার। কিছু শর্ত দিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হন সাজ্জাদ।
তবে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে রাজি হননি তিনি। তিনি বলেন, বিভিন্ন কারণে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতি তার নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে।
কেন নেতিবাচক ধারণা আছে সে বিষয়ে সাজ্জাদ হোসেন বলেন, কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যম আমার বক্তব্য নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করছে; আমি এই কথাগুলো কখনো বলিনি এবং কেন হঠাৎ এমন একজনের কথা বলব যার সাথে আমার সম্পর্ক নেই। খবরটি প্রকাশের আগে কেউ আমার মতামত জানার চেষ্টা করেনি। কিন্তু তারা সবাই আমার স্ত্রী-সন্তান বলে আমার বক্তব্য না নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে। কিন্তু আমার পরিবার আমাকে জানিয়েছে আমি প্রায় আড়াই বছর আগে পাকিস্তানি মহিলাকে আইন অনুযায়ী তালাক দিয়েছি এবং তার গর্ভে আমার কোনো সন্তান নেই। জান্নাত নামের শিশুটি তার সাবেক স্বামী পাকিস্তানের নাসিরের। তা সত্ত্বেও মিডিয়া আমার স্ত্রীর সন্তান হিসেবে ছবি প্রচার করছে।
সাজ্জাদ হোসেন মজুমদারের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, তিনি জীবিকার তাগিদে ২০০৮ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে চালক হিসেবে কাজে যোগ দেন। কাজের সুবাদে সেখানে যাওয়ার পর ২০১৪ সালের শুরুতে পাকিস্তানের লাহোর প্রদেশের মুলতান রোডের সাকি স্ট্রিট সৈয়দপুরের বাসিন্দা মাকছুদ আহমেদ ও শামীমা আক্তারের মেয়ে মাহা বাজোয়ার সঙ্গে।একপর্যায়ে তারা একে অপরের কাছাকাছি যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। অবশেষে তাদের প্রেম বিয়েতে রূপ নেয়।
২০১৪ সালের ২শে নভেম্বর তারা পাকিস্তানে গিয়ে সে দেশের নিয়ম অনুযায়ী দুই লাখ টাকা কাবিন নামায় নিয়ে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তারা বিভিন্ন দেশ-বিদেশে আনন্দ ভ্রমণে যান। সাজ্জাদ পাকিস্তানি নারীদের কোনো শর্ত পূরণ করেননি। তিনি তার স্ত্রীর সকল দায়িত্ব পালন করতে শুরু করে। সাজ্জাদ হুসেনের দুবাইতে উপার্জিত অর্থ দিয়ে মাহা বাজওয়া পাকিস্তানের লাহোরে জমি কিনেছিলেন। পরে ওই জমিতে বিলাসবহুল বাড়ি তৈরি করেন।
মোটা অংকের টাকা খরচ করে ২০১৮ সালে তিনি তার স্ত্রী মহা বাজোয়াকে বাংলাদেশে তার বাড়িতে নিয়ে আসেন। সেখানে আসার পর বাংলাদেশের রীতি অনুযায়ী এক লাখ টাকা কাবিনে রেজিস্ট্রি করেন। মাহা বাজওয়া বিয়ের পর সেখানে ২০ দিন অবস্থান করেছিলেন। পরে নিজ দেশে চলে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করলে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুরোধ করেন সাজ্জাদ। এতে মাহা বাজোয়া অনীহা প্রকাশ করেন। পরে কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে স্ত্রী মাহা বাজোয়াকে পাকিস্তানে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন এবং সাজ্জাদ হতাশা নিয়ে নিজ কর্মস্থল ফের দুবাই চলে যান।
দীর্ঘ ৭ বছর মান অভিমানেই চলছিলো সাজ্জাদ ও মাহা বাজোয়ার দাম্পত্য জীবন। বাংলাদেশে এসে পাকিস্তান চলে যাওয়ার পর মাহার মন পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। পরে মাহার খোঁজে সাজ্জাদ পাকিস্তানে যান।
সেখানে গিয়ে জানতে পারেন মাহা বাজোয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য। বিয়ের ৭ বছর পর সাজ্জাদ জানতে পারেন মাহা পাকিস্তানের পেশোয়ার রাজ্যে আরেকটি স্বামী ও সন্তান আছে। লাহোরে খোঁজ নিয়ে দেখেন সত্যিই পেশোয়ারে নাছির নামের এক ব্যক্তিকে ২০১২ সালে বিয়ে করেন মাহা বাজোয়া এবং জান্নাত নামে কন্যা আছে। প্রতারণা করে পূর্বের স্বামী সন্তানের কথা গোপন রেখে সত্যকে আড়াল করে দ্বিতীয় বিয়ে করা নিয়ে তাদের মধ্যে চলে পারিবারিক কলহ।
এর মধ্যে পাকিস্তানি নারী সাজ্জাদের সরলতার সুযোগ নিয়ে সুকৌশলে পাকিস্তানে একটি বাড়ি ও অর্থকড়ি, স্বর্ণালংকার বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেন। পাকিস্তানি নারীকে সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে নিঃস্ব যুবক সাজ্জাদ অবশেষে প্রতারিত হয়ে দেশে ফিরেন। সবকিছু সহ্য করেও মাহ বাজোয়াকে বাংলাদেশে আসার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু মাহা তার কথার অমান্য করে সাজ্জাদকে পিতা মাতা ছেড়ে পাকিস্তানে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য চাপপ্রয়োগ করেন।
এনিয়ে উভয়ের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলে স্ত্রী মাহা বাজোয়াকে ২০২২ সালের ২৩ মে তালাক দেন। এদিকে তালাকের খবর পেয়ে গত ১৭ নভেম্বর পাকিস্তান থেকে ঢাকায় এসে এক আইনজীবীর পরামর্শ নিয়ে গত ৮ ডিসেম্বর সাবেক স্বামীর বাড়ি চুনারুঘাটের বাড়াইলে আসেন। সেখানে তার স্বামী সাজ্জাদকে না পেয়ে সাজ্জাদের ভাবির বাসায় অবস্থান করেন।
পরে মাহা বাজোয়া চুনারুঘাটের ঠিকানা দেখিয়ে সাজ্জাদ হোসেনের বিরুদ্ধে গত ১২ ডিসেম্বর হবিগঞ্জে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। আদালতের বিচারক রাহেলা পারভীন সাজ্জাদ হোসেন মজুমদারের বিরুদ্ধে সমন ইস্যুর আদেশ দেন। মামলাটি হয় যৌতুক আইনের ৩ ধারায়। পরে গত ১৩ ডিসেম্বর আইনজীবীর পরামর্শে পারিবারিক আদালতে আরেকটি মামলা দায়ের করেন।
সর্বশেষ ১৪ ডিসেম্বর রাতে মারপিটের অভিযোগে চুনারুঘাট থানায় মাহা বাজোয়া বাদী হয়ে সাজ্জাদ হোসেন মজুমদারকে প্রধান আসামি করে আরেকটি মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় তার বড় বোন শাহনাজ বেগম মনি, তার স্বামী মো. মনসুর আহমেদ ও তার বর্তমান স্ত্রী মুন্নি আক্তারের নাম উল্লেখ করেন।
মাহা বাজোয়ার দাবি এ তালাক আইনসম্মত নয় এবং তিনি তালাক সংক্রান্ত কোনো নোটিশ পাননি বলে জানিয়ে স্বামীর অধিকার আদায়ে মামলা দায়ের করেন। তিনি বলেন, যেকোনো মূল্যে স্বামীকে চাই।
মাহা আরও জানান, তিনি ঢাকায় চলে যাবেন। সেখানে বিভিন্ন ব্যবসায়িক কাজে ব্যস্ত থাকবেন। ১৯ ডিসেম্বর পাকিস্তান চলে যেতে পারেন। পরে মামলার জন্য আবারো তিনি হবিগঞ্জে আসবেন।
আদালত সূত্রে জানা যায়, দুবাইয়ের চুনারুঘাট উপজেলার উত্তর বাজার বড়াইলের সফিউল্লাহ মজুমদারের ছেলে সাজ্জাদ হোসেন মজুমদার ১০ বছর আগে পাকিস্তানের লাহোর প্রদেশের সৈয়দপুর মুলতান রোডের সাকি স্ট্রিটের বাসিন্দা মাকসুদ আহমেদের মেয়ে মাহা বাজওয়ার সঙ্গে দেখা করেন। . পরে ৩০ লাখ টাকা যৌতুক নিয়ে তাদের বিয়ে হয়।
কিন্তু সাজ্জাদের দাবি, পাকিস্তানি ওই নারী আদালতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মামলা করেছেন ২ লাখ টাকার কাবিনে এডিট করে ৩০ লাখ বানিয়েছেন এবং তার সাবেক স্বামীর সন্তানকে আমার বলে মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, আমি বাসায় নেই। এ উপলক্ষে কুচক্রী মহলের সহায়তায় মাহা আমার বাড়িতে গিয়ে ৩টি নাটকীয় মামলা করে। আমার কাছে নথি আছে। আইনগতভাবেই মোকাবেলা করব।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের জুলাই মাসে মাহা বাজোয়া সাজ্জাদ হোসেন মজুমদারকে বাংলাদেশে তার স্বামী হিসেবে দাবি করেয এবং তিনি স্পনসরকারী হিসেবে বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিলেন। জেলা গোয়েন্দা পুলিশ তদন্তের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট থানাকে দেয়।
পরে থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) লিটন রায় সাজ্জাদের কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মাহা বাজোয়া সাজ্জাদের তালাকপ্রাপ্ত। তাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। ১৪ জুলাই, ২০২২-এ, হবিগঞ্জের পুলিশ সুপারের কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হলে, ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে এবং মাহা বাজওয়া সেই সময়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারেনি।
এ ব্যাপারে চুনারুঘাট থানার ওসি হিল্লোল রায় বলেন, পাকিস্তানি নারীর অভিযোগের ভিত্তিতে থানায় মামলা হয়েছে। আমরা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে কাজ করছি।