বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি থেকে বিভিন্ন কারণে বহুসংখ্যক নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু সরকার হটানোর আন্দোলনকে বেগবান করতে এবং দলকে শক্তিশালী করতে সেই সকল নেতাকে দলে ফিরিয়ে আনার জন্য তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে শতাধিক নেতাদেরকে পুনরায় দলে ফিরে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে এখানে পুনরায় তাদের কিছু প্রক্রিয়া মেনে আসটে হবে।
বিএনপির শতাধিক নেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হচ্ছে। তৃণমূলকে জোরদার ও চলমান আন্দোলনের স্বার্থে এসব নেতাকে দলে ফিরিয়ে আনছে দলটি। তাদের অধিকাংশই দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বহিষ্কৃত হন।
সোমবার দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের মাধ্যমে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে আবেদন জানানোর পর অতীতের অপরাধের ধরন ও বর্তমান কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে তাদের দলে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেন স্থায়ী কমিটির নেতারা।
তবে শীর্ষ নেতৃত্ব সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করায় যাদের বহিষ্কার করা হয়েছে তাদের বিষয়ে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে হাইকমান্ডকে। বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা গনমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, আগামী দিনের আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। তাদের দলে ফিরিয়ে আনতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এমনও হতে পারে যে, প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পদ থেকে বহিষ্কৃত নেতাদের কাছে আবেদন চাওয়া হবে।
স্থানীয় পর্যায়ে শত শত নেতা আছেন যারা নিবেদিতপ্রাণ ও পরীক্ষিত। তারা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আবেদন করলে বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করা হবে। তবে সাবেক সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান, অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু, সিলেটের শফি আহমেদ চৌধুরীকে দলে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
কারণ, তাদের একজন দলীয় হাইকমান্ড সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। দুইজন দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে সিটি নির্বাচনে এবং আরেকজন সিলেট-৩ উপ-নির্বাচনে অংশ নেন, যা দলীয় হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বর্জন প্রত্যাহারের বিষয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা আসেনি। তবে নিয়ম অনুযায়ী বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহারের জন্য সংশ্লিষ্ট জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বা আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের সুপারিশসহ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করতে হবে। সেই আবেদন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে উত্থাপিত হয়। তিনি বিবেচনা করলে বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করা হবে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিগত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি দলগতভাবে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিলেও তা অমান্য করায় ২০৫ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় দেড় শতাধিক নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। এছাড়া দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে আরও ৩০ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গত চার বছরে শতাধিক নেতা দলীয় কার্যালয়ে আবেদন করেছেন, তাদের বহিষ্কার আদেশও প্রত্যাহার করা হয়েছে।
সম্প্রতি ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাধারণ সম্পাদকের বাসভবনে হামলার ঘটনায় বহিষ্কৃত ১৮ জনের মধ্যে তিন নেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ ছাড়া নোয়াখালী জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শহিদুল ইসলাম কিরণ, সুনামগঞ্জ জেলা জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সাবেক সভাপতি মদিনা আক্তার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার আওতাধীন ভোলাহাট উপজেলা জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সাবেক সহ-সভাপতি শাহনাজ খাতুন, নোয়াখালী জেলা বিএনপির সাবেক কোষাধ্যক্ষ আবু হেলাল হোসেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মো. আশরাফুল হক, চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি মো. মনজিল হোসেন ভিপি, নাটোর জেলা সদর উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক শেখ এমদাদুল হক আল-মামুনসহ একাধিক নেতাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
এখনো অর্ধ শতাধিক নেতার আবেদন রয়েছে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। তাদের মধ্যে রয়েছেন টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান কাজী শহিদুল ইসলাম, জামালপুর জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদ, দাউদকান্দির কেএমআই খলিল, নাটোর সদরের সাইফুল ইসলাম ডিউক, বাগাতিপাড়া পৌরসভার মেয়র ও উপজেলার সাবেক ১নং যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যক্ষ মো. বিএনপি। শরিফুল ইসলাম লেলিন, চট্টগ্রাম দক্ষিণ বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শেখ মোঃ মহিউদ্দিন ও আব্বাস প্রমুখ। তাদের মধ্যে, লেলিন দল থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। গত মার্চে তিনি পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে পুনর্বহালের আবেদন করেন।
খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়া মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জুও কয়েক মাস আগে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আবেদন করেন। সেখানে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হতে চান বলে উল্লেখ করেন।
এ ছাড়া ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি এজমল হোসেন পাইলট, ইখতিয়ার কবির, জয়দেব জয়, মামুন বিল্লাহ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ, বায়েজিদ আরেফিন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দবির উদ্দিন তুষার, যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আজম সৈকত, আব্দুল মালেক ও সদস্য মো. একই সঙ্গে বহিষ্কার করা হয় আজিম পাটোয়ারীকে। , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক বাশার সিদ্দিকী, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি জহিরউদ্দিন তুহিন। তারা সবাই ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ ও পরীক্ষিত নেতা।
তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছেন। এমনকি স্থায়ী কমিটির সদস্যরাও প্রত্যাহারের বিষয়ে একমত হয়েছেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এই ১২ নেতার বহিষ্কারাদেশ এখন পর্যন্ত প্রত্যাহার করা হয়নি।
সূত্র জানায়, আন্দোলন-সংগ্রামে সবার ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা চায় বিএনপির হাইকমান্ড। সেজন্য বিগত দিনে বিভিন্ন অভিযোগে বহিষ্কৃতদের পুনর্বহাল করতে চায় দলটি। গত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বহিষ্কৃত নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য কয়েকজন নেতাকে দায়িত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন নেতারা। যাতে তারা প্রত্যাহারের জন্য কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আবেদন করে।
একই সঙ্গে আগামী দিনে বিভাগীয় পর্যায়ের সমাবেশে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চায় হাইকমান্ড। তবে বহিষ্কারের পরও হাইকমান্ডের আনুগত্য থেকে যারা দলীয় কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন তাদের পুনর্বহাল করতে কোনো আপত্তি থাকবে না।
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা অভিযোগ করলেও স্থানীয় পর্যায়ের অনেক প্রভাবশালী নেতাও আছেন যারা নানা কারণে বহিষ্কৃত হয়েছেন। তারা বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের আবেদন করলেও কোনো প্রতিকার পাননি।
কারণ, যারা নিজ নিজ এলাকায় সংসদ নির্বাচন করতে চান, তারা কর্মকর্তাদের অপপ্রচার করে তাদের আবেদন নিষ্পত্তি বা সমাধান করতে দেন না। তবে কারও স্বার্থ না দেখে দল ও আন্দোলনের জন্য বিগত দিনে যারা রাজপথে ছিলেন তাদের বহিষ্কার প্রত্যাহার করা উচিত বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
তবে ভিন্ন ধরনের তথ্য এসেছে কিছু নেতার বিরুদ্ধে, আর সেটা হচ্ছে যে সকল নেতারা সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চান, তাদেরকে তাদের বিরোধীরা নানা ধরনের অপপ্রচার চালিয়ে তাদেরকে দলে ফিরতে তাদের সমাধানে আসতে দেন না। এদিকে কেন্দ্রীয় নেতারা মনে করেন যারা নিজেদের স্বার্থের বাইরে গিয়ে দলের জন্য কাজ করেছিলেন এবং নিজেদের মতো করে আন্দোলনে নামেন প্রথমেই তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেয়া উচিত এমনটাই জানিয়েছেন।