বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ৫০ লাখ সদস্যের মধ্যে প্রায় অর্ধেক (২.৫ মিলিয়ন) নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা রয়েছে। নির্বাচনের আগে এসব নেতাকর্মীদের আন্দোলনের চেয়ে আদালতে হাজিরা ও মামলা-মোকদ্দমা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়। প্রতিদিন হাজার হাজার নেতাকর্মীকে আদালতে হাজিরা দিতে হয়।
শনিবার নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত এক বিশেষ প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।
নিউইয়র্ক টাইমস দক্ষিণ এশিয়ার ব্যুরো প্রধান মুজিব মাশালের লেখা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনাকীর্ণ আদালত কক্ষগুলোতে দেশের বহুদলীয় গণতন্ত্রকে পরিকল্পিতভাবে শ্বাসরোধ করা হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিচারকের সামনে দাঁড়ান বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মী ও সমর্থক। তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো সাধারণত অস্পষ্ট এবং এর পক্ষে সামান্যই প্রমাণ পাওয়া যায়। নির্বাচনের কয়েক মাস আগে বিরোধী দলকে নিশ্চল করে দেয়ার চেষ্টা এখন বেশ স্পষ্ট।
সম্প্রতি একদিন সকালে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিএনপি নেতা সাইফুল আলম নীরবকে হাতকড়া পরিয়ে তোলা হয়। নীরবের নামে ৩১৭ থেকে ৩৯৪টি মামলা রয়েছে। তার আইনজীবীরাও মামলার সংখ্যা নিয়ে অনিশ্চিত। আদালতের বাইরে আরও কয়েক ডজন সমর্থক ছিল যাদের বিরুদ্ধে ৪০০টি মামলা রয়েছে। তারা বৃষ্টি ভেজা স্যাঁতসেঁতে একটি গলিতে অপেক্ষা করছিল। পুলিশ বারবার বাঁশি বাজিয়ে তাদের সরিয়ে দিচ্ছিল নতুন রাজনৈতিক বন্দীদের জন্য।
আব্দুল সাত্তার নামে এক সমর্থক বলেন, আমি আর কোনো কাজ করতে পারছি না। তার বিরুদ্ধে ৬০টি মামলা রয়েছে। সপ্তাহে তিন-চার দিন কাটত তাঁর দরবারে। এক মামলা থেকে অন্য মামলায় ছুটে যাওয়াই এখন তার জীবন।
মুজিব মাশাল লেখেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ মানেই একটি অর্থনৈতিক সাফল্যের গল্প ছিল। পোশাক রপ্তানি শিল্পের প্রতি দৃঢ় ফোকাস বাংলাদেশে ডলারের স্থিতিশীল প্রবাহ নিশ্চিত করেছে। শিল্পটি অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়িয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছে।
তবে এই সাফল্যের আড়ালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজনৈতিক সংহতির প্রচারণা চালাচ্ছেন। বিরোধীদলীয় নেতা, বিশ্লেষক ও কর্মীরা বলছেন, এর লক্ষ্য বাংলাদেশকে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করা। গত ১৪ বছর ক্ষমতায় থেকে তিনি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছেন। এই স্থানগুলো তার অনুসারীদের দ্বারা পরিপূর্ণ। তার টার্গেটে রয়েছেন শিল্পী, সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট এবং এমনকি নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসও।
ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। বিরোধীরা ভোটটিকে দেখছে তাদের শেষ লড়াই হিসেবে।
অপরদিকে শেখ হাসিনার সহযোগীরা বলছেন, কোনোভাবেই বিএনপিকে জিততে দেওয়া যাবে না। কারণ তারা যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে তারা আমাদেরকে ‘হত্যা করবে’।
প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা মহামারি ও ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। খাদ্য ও জ্বালানির দাম বেড়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের অর্থনীতিতে এটা বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান খাদ্যমূল্য ও বিদ্যুতের ঘাটতি নিয়ে জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। যখন শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই নির্বাচন করার কথা বলছেন তখন বিরোধীদল জনমনে সৃষ্ট সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার ভয়, খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি, বিদ্যুতের ঘাটতির মতো সমস্যাকে কাজে লাগাতে চাইছে।
কিছুদিন আগে বড় একটি র্যালির আয়োজন করে বিএনপি। সেখানে তারা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন এবং আটক দলীয় রাজনৈতিকদের মুক্তি দাবি করে। তবে তারা ঢাকার দিকে যতই এগিয়ে আসতে থাকে স্লোগানগুলো ততই উত্তেজনাকর হয়ে পড়ছিল।
একই সময়ে পুলিশের বাধাহীন অবস্থায় ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে একটি মিছিলের আয়োজন করা হয় যেখানে নেতারা বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সমালোচনা করেন। তাদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের কথা স্বীকার করেন। সম্প্রতি আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের জন্য আলাদা ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে তারা।
কয়েক সপ্তাহ পর বিএনপি আরেকটি সমাবেশ করতে গেলে সরকার শক্তি প্রদর্শন করে। এ সময় নতুন করে ৫শ মামলা দায়ের করা হয়। এতে বোঝা যায়, পশ্চিমাদের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কারণে সরকার খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
সরকার জনগণের বিরুদ্ধে তরবারি চালাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাসিত আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী আশরাফ জামান। বর্তমানে তিনি এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, একই মামলায় অনেককে আসামি করছে পুলিশ। এর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ বা পুলিশকে বাধা দেওয়ার মামলা। এসব মামলায় পরিচয়হীন অনেকের কথা উল্লেখ করা হয়ে থাকে যাতে নতুনদেরও যেকানো সময় এসব মামলায় অন্তর্ভুক্ত ও গ্রেফতার করা যায়।
মানবাধিকার কর্মীরা জানান, আসামিরা কয়েক মাস জেলে ছিলেন এবং বিভিন্ন হয়;রানির শিকার হন। আইনজীবীরা বলেন, রাজনৈতিক মামলায় জামিন পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।