পেশায় প্রকৌশলী বাংলাদেশী নাগরিক শরীফ ইমরান এবং জাপানী মা নাকানো এরিকো যিনি পেশায় একজন চিকিৎসক, তাদের দাম্পত্য জীবনের বিচ্ছেদের পর তাদের তিন সন্তানের দাবি নিয়ে বিপত্তির সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন মা-বাবা দুজনেই। বর্তমানে বাংলাদেশের আদালতে তাদের এই বিষয়টি নিয়ে মামলা বিচারাধীন রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে জাপানি মা নাকানো এরিকো বাংলাদেশ থাকা তার দুই সন্তানকে নিয়ে গভীর রাতে লুকিয়ে দেশে ফেরার সময় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নিয়ে হাজির হন তার স্বামী ইমরান। এরপর আর যাওয়া হলো না জাপানি মা নাকানো এরিকোর।
এই ঘটনার পর দুই সন্তান জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনার জাপানি মা নাকানো এরিকো বাংলাদেশের মানুষের উদ্দেশে আবেগঘন চিঠি লিখেছেন। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, এখানে জীবন দুর্বিষহ। আমি এখন বাংলাদেশে বন্দী জীবন যাপন করছি। আমি আমার চাকরি হারিয়েছি এবং আমার মাকে হারাতে যাচ্ছি। মাকে দেখতে কেউ সাহায্য করছে না। বাকিটা আপনাদের বিবেকের ওপর ছেড়ে দিলাম।
সোমবার (২৬ ডিসেম্বর) আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনিরের মাধ্যমে পাঠানো এক বার্তায় জাপানি মা নাকানো এরিকো বলেন, আমি নাকানো এরিকো। একজন অসহায় জাপানি মা। আজ এখানে আমি একটি কঠিন সময়ের মুখোমুখি। ইমরান শরীফ (সন্তানের বাংলাদেশী বাবা) ২৩ ডিসেম্বর রাতে আমার ছোট মেয়ে লায়লা লিনাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়। আমি তার হদিস জানি না. বারবার ই-মেইল করলেও উত্তর আসে না।
তিনি বলেন, “আমার মায়ের বয়স ৭৬ বছর এবং তিনি তীব্র শ্বাসযন্ত্রের রোগে ভু”গছেন। সম্প্রতি তার স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে এবং তিনি জাপানের কাগাও রোসাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তিনি আমাকে এবং নাতি-নাতনিদের শেষবারের মতো দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। তৃতীয় মেয়ে সোনিয়া আমার মায়ের অসুস্থতার কারণে কার্যত একা এবং সে আমার জন্য ক্রমাগত কাঁদছে।
এখন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং পারিবারিক আদালত ছুটিতে রয়েছে এবং পারিবারিক মামলার পরবর্তী তারিখ ১১ জানুয়ারি। তাই আমি ইমরান শরীফের সাথে মৌখিকভাবে জানিয়েছিলাম যে, আমি এই ছুটিতে অল্প সময়ের জন্য মেয়েদের সাথে নিয়ে জাপানে যেতে চাই এবং ১০ জানুয়ারির মধ্যে ফিরতে চাই।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট পারিবারিক আদালতকে তিন মাসের মধ্যে মামলা শেষ করার নির্দেশ দেন। কিন্তু ইমরান বিলম্ব করছেন এবং প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও বিচার চলছে। তাই আমার মা এবং তৃতীয় মেয়ে সোনিয়ার সাথে দেখা আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে আমার অবর্তমানে মেয়েদের দেখাশোনা করার কেউ নেই। এমতাবস্থায় আমি তাদের সাথে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম আমার মু”মুর্ষু মাকে দেখতে। এছাড়া, ইমরান আমার ব্যক্তিগত জীবন সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের জন্য বেশ কিছু গুপ্তচর/গোয়েন্দা নিয়োগ করেছে। আমরা কাছের শপিং মলেও যেতে পারি না। বিষয়টি থানায় ও পারিবারিক আদালতে জানালেও তারা হস্তক্ষেপ করেনি।
ইমরান আমার ড্রাইভার, অনুবাদক, বন্ধু এবং আইনজীবীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা/অভিযোগ দায়ের করেছে। এমনকি আমার বাড়ির রিয়েল এস্টেট ম্যানেজারকেও সে হুমকি দিয়েছে। ইমরান তার মেয়েকে আদালতের নির্ধারিত সময় ও স্থানের বাইরে নিয়ে আদালতের আদেশ অমান্য করে চলেছেন। এমনকি প্রকাশ্যে বেশ কয়েকবার আমাকে শারীরিকভাবে লা”ঞ্ছিত করেছে। ভিসা কর্তৃপক্ষ আমাকে সহযোগিতা করেনি। তারা মূলত আমার ভিসা প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করে এবং অকারণে বিভিন্ন প্রমাণপত্র দেখতে চায়।
এদিকে তাদের বড় মেয়ে জেসমিন মালেকা চিঠিতে জানিয়েছেন, তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান। জাপানে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষার কথা জানিয়েছে সন্তানটি।
২০০৮ থেকে ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত স্বামী স্ত্রী এক সাথে ছিলেন। এই দম্পতির ঘরে সেই সময়ের মধ্যে তিন কন্যাসন্তান। কিন্তু সেই সময়ে জাপানি মা এবং ইমরান দুজনেই পুরোপুরি আলাদা। এদিকে সন্তানদেরকে দুজনেই আলাদা আলাদাভাবে কাছে পেতে জাপানী মা জাপানের আদালতে এবং বাবা শরীফ বাংলাদেশের আদালতে মামলা দায়ের করেন। এদিকে জাপানে মামলাটির বিচার শেষ না হওয়ার আগেই শরিফ দুই মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। এরপর অনন্যোপায় হয়ে জাপানী মা টোকিও ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন।