আলোচিত সেই মিতু হ/ত্যার বিচার কার্য চলচ্ছে দীর্ঘ দিন ধরে। তবে প্রথমে বাদি হয়ে মামলা করলেও পরে আসামি হয়ে যান সাবেক এসপি বাবুল আক্তার। মামলাটির তদন্ত করছে পিবিআই কিন্তু স্ত্রীর হ/ত্যার আসামী সাবেক এসপি বাবুল আক্তার আইনের ফাঁকফোকর জানা থাকায় বিভিন্ন কৌশলে বাঁচার চেষ্টা করছে বলে জানা যায়। বাবুল আক্তার-পিবিআই লড়াইয়ের নেপথ্যে নিয়ে ভিন্ন সব তথ্য বের হয়ে এসেছে।
চট্টগ্রাম আদালতে ১৬ মাস ধরে চলছে সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার আর তদন্ত সংস্থা পিবিআইর আইনি লড়াই। এতে আলোচিত মাহমুদা খানম মিতু হত্যার মামলা নিয়েছে নতুন নতুন মোড়। কখনও বাবুলের শ্বশুরপক্ষ তাঁর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, কখনও বা গেছে বিপক্ষে। বাবুল চাকরি হারিয়েছেন। আবার সেই চাকরি ফেরত পেতে গেছেন প্রশাসনিক টাইব্যুনালে।
বাবুল প্রথমে এ মামলার বাদী ছিলেন। কিন্তু কয়েক বছর পর করা হয় আসামি। মামলার আসামিদের নিয়েও হয়েছে অনেক লুকোচুরি। মামলার শুরু থেকেই নিখোঁজ ছিলেন প্রধান আসামি মুছা। সে কোথায় আছে কেউ জানে না। মামলার অপর দুই আসামি ক্র/সফায়ারে মা/রা গেছেন। দুই আসামি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে ওই বিবৃতিতে তারা কোথাও বাবুল আক্তারের নাম উল্লেখ করেননি। এভাবেই এ মামলার নানা রহস্য ও প্রশ্ন আলোচনা এসেছে। পিবিআই প্রধানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে রিমান্ডে নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন বাবুল আক্তার। তিনি বারবার স্ত্রীকে হ/ত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। অন্যদিকে গতকাল ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ‘বাবুল আক্তার একজন চতুর মানুষ। তিনি যা বলেছেন সে বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। তিনি যা বলেছেন, তা বাস্তবসম্মত কিনা তা তদন্তের পর জানা যাবে।
মিতু হ/ত্যা মামলায় বাবুল গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই তিনি আদালতে একের পর এক নতুন আবেদন করছেন। কখনও নথি থেকে ডকুমেন্ট ‘টেম্পারিং’ বা ঘষামাজার আশঙ্কায় আদালতে পিটিশন দাখিল করেছেন। আর কখনো পিবিআই তদন্তে আপত্তি করেন। সন্তানদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে চট্টগ্রামের আদালত নির্দেশ দেওয়ার পরও তাতে সম্মতি দেয়নি বাবুলের পরিবার। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে সন্তানদের সঙ্গে কথা বলেছে পিবিআই। অতি সম্প্রতি রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নি/র্যাতন করার নতুন অভিযোগ এনেছেন বাবুল। এ বিষয়ে আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর আদেশের দিন ধার্য করেছেন আদালত।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা জানান, বাবুল বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ করে বারবার আদালতে আবেদন করছেন। পিবিআইর তদন্তের ওপর তিনি বারবারই অনাস্থা জানিয়েছেন।
চট্টগ্রাম মহানগরের পিপি ফখরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, মিতু হ/ত্যা মামলাটি শুধু চট্টগ্রাম নয়, সারাদেশে একটি স্পর্শকাতর ও আলোচিত মামলা। এই ক্ষেত্রে, বাদী-বিবাদী সর্বদা আইনের ফাঁক খুঁজে পেতে এবং সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ ও আদালত যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করলেই তদন্ত সংস্থা এ মামলার তদন্ত সুষ্ঠুভাবে শেষ করতে পারে। এক প্রশ্নের জবাবে পিপি বলেন, আসামি নিজেকে বাঁচাতে আদালতে একের পর এক আবেদন করেছেন। সেটা সবাই বোঝে। অভিযুক্ত বাবুল সাবেক এসপি হওয়ায় তদন্তের ফাঁকফোকর ও ফলাফল সম্পর্কে তিনি ভালো করেই জানেন।
বাবুলের আইনজীবী ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বলেন, মিতু হ/ত্যা মামলায় আমার মক্কেলকে ফাঁসানো হয়েছে। তারা পিবিআইকে বিশ্বাস করে না। পিবিআইর ওপর তাঁদের আস্থা নেই। পিবিআই মামলার কেস ডকেট (সিডি) থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ঘষামাজা, টেম্পারিং অথবা সরিয়ে ফেলার আশঙ্কা রয়েছে। তাই কেস ডকেটের অনুলিপি জুডিশিয়াল হেফাজতে রাখার আবেদন করলে আদালত ১৭ নভেম্বর সিডির একটি অনুলিপি জুডিশিয়াল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। তারা পিবিআই ছাড়া অন্য কোনো সংস্থার মাধ্যমে মামলার তদন্ত চান। এসব বিষয়ে আদালতে একাধিক আবেদন করা হয়েছে।
ডকুমেন্ট টেম্পারিং করার আশঙ্কায়’ পিবিআইর ফাইনাল রিপোর্ট ও মিতু হ/ত্যার সব নথিপত্র জুডিশিয়াল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। গত বছরের ২৩ আগস্ট বাবুলের আবেদন গ্রহণ করে আদালত এ আদেশ দেন। আদালত বলেছেন, মিতু খু/নের পর তাঁর স্বামী বাবুলের বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানায় করা মামলার সব কাগজপত্র জুডিশিয়াল হেফাজতে রাখতে হবে।
অন্য আসামিদের সঙ্গে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ এড়াতে আট দিনের ব্যবধানে দুই আদালতে জামিনের আবেদন করেন বাবুল আক্তার। কারণ, কোনো মামলায় আসামির জামিন আবেদন ম্যাজিস্ট্রেট, দায়রা জজ বা হাইকোর্টে শুনানির বিচারাধীন থাকলে আদালত তার রিমান্ড আবেদন শুনানি করে না। বাবুল সেই সুযোগ নেন বলে অভিযোগ তদন্তকারী সংস্থার। গত বছরের ১৮ আগস্ট তিনি চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিনের আবেদন করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আদালত বাবুলের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন। এর আগে গত ১০ আগস্ট চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রথম জামিন আবেদন করেন তিনি। সেখানে উভয়পক্ষের শুনানি শেষে তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করা হয়। ১২ মে বাবুলকে পিবিআই হেফাজতে নিয়ে পাঁচ দিন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
এ ছাড়া বাইরের হাসপাতালে থাকার জন্য আদালতে আবেদন করেন বাবুল। তিনি নিজেকে ‘গুরুতর অসুস্থ’ হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করছেন। তিনি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার তথ্যও দেন।
আদালতে বাবুলের দাখিল করা সর্বশেষ পিটিশন হলো, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালানোর অভিযোগ। রিমান্ডে নেওয়ার ১৬ মাস পর এসে নির্যাতনের অভিযোগ করছেন আসামি। গত ২২ আগস্ট চার্জশিট দাখিলের সাক্ষ্যস্মারকে সম্মতি দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মহানগর পিপি ফখরুদ্দিন চৌধুরী। সাক্ষ্যস্মারকে বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এ বিষয়টি মিডিয়ায় প্রকাশের পর গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ জেবুন্নেছা বেগমের আদালতে একটি নালিশি মামলা করেন বাবুল। সেখানে তাঁকে রিমান্ডে নির্যাতনের অভিযোগ করেন।
চট্টগ্রামের সাবেক বিভাগীয় বিশেষ পিপি অ্যাডভোকেট মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, হেফাজতে নির্যাতন আইনে মামলা করতে হলে আসামিকে নি/র্যাতন করা হয়েছে এবং তার শরীরে সেই নি/র্যাতনের চিহ্ন রয়েছে- তা আগে প্রমাণ করতে হবে। এ আইনে মামলা হলে ঘটনার দীর্ঘদিন পরও যদি মেডিকেল বোর্ড গঠন করে শরীর পরীক্ষা করে কোনো উপসর্গ না পাওয়া যায়, তাহলে এ আইনে মামলা টিকবে না। বাবুল এসপি হওয়ায় তার এই আইন জানা উচিত।
গত বছরের ২৭ অক্টোবর মিতু হ/ত্যার প্রথম মামলায় পিবিআইয়ের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনের প্রতিবাদ করেন বাবুল। গত ৩ নভেম্বর এ আদেশে বাবুলের আপত্তি নাকচ করে দেন আদালত। একই সঙ্গে মামলা দুটি একত্রিত করে তদন্ত অব্যাহত রাখতে পিবিআইকে নির্দেশ দেন আদালত।
২০২১ সালের ১১ মে মিতু খুনে বাবুল আক্তারকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। ১২ মে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০১৬ সালের ৫ জুন চট্টগ্রাম নগরীর ও আর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে গু/লি ও ছু/রিকাঘাতে নিহত হন তৎকালীন পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু।
প্রসঙ্গত, আইনের লোক হওয়ায় নানা কৌশল অবলম্বন করছেন মামলা থেকে বাচার জন্য সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা। তবে আইন সংস্থা থেকে বিচারের তদন্ত সঠিক ভাবে হচ্ছে বলে জানিয়েছে।