আলোচিত পদ্মা সেতু তৈরী নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয় দেশে ও দেশের বাহিরে। তবে সব বিতর্ককে পিছনে ফেলে শেখ হাসিনার সাহসিকতায় নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ প্রায় শেষের দিকে। এ মাসেই উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে চলাচলের জন্য। তবে অনেকেই ধারনা করেছিল এটা তৈরী করা অসম্ভব হবে। এবার পদ্মা সেতু অজানা তথ্য সম্পর্কে যা বলা হল।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘পদ্মা সেতু এবং এর আর্থ-সামাজিক প্রভাব’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। রোববার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনানন্দ দাশ কনফারেন্স হলে এ সেমিনার শুরু হয়। এ সেমিনারে জানা গেল পদ্মা সেতুর অজানা অনেক তথ্য।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ কর্তৃক আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত।
এ সময় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. আইনুন নিশাত বলেন, পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে। দক্ষিণ হবে শিল্প নগরী; যা দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে অর্থনীতিতে আবর্তিত হবে বরিশালসহ পুরো দক্ষিণাঞ্চল। বরিশালকে পর্যটনের জন্য অনেক আকর্ষণীয় করে তোলা যাবে, সেই জিনিস এখানে রয়েছে। আর ভোলার গ্যাস বরিশালে আনা হলে শিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন হবে।
যমুনা এবং পদ্মা সেতু করার সময় বিশ্ব ব্যাংক জড়িত ছিল, যমুনাতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিল, পদ্মা সেতুতে তারা এক সময় পিছুটান দিয়েছিল একটা অদ্ভুত কারণ দেখিয়ে। পরে তারা বুঝতে পারে তাদের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল।
আমি কখনই পদ্মার ওপর সেতু নির্মাণে বিশ্বাস করিনি। এটি একটি খুব শক্তিশালী নদী। এখানে ফেলোশিপ প্রতি সেকেন্ডে সাড়ে চার মিটার। অর্থাৎ কি প্রবল স্রোত। স্বাভাবিকভাবেই নদীটি মাওয়ায় এলে এর প্রস্থ ছিল দুই থেকে আড়াই কিলোমিটার, ফলে তা ছিল অনেক গভীর। শীতকালে এর গভীরতা ৮০-১০০ ফুট এবং বর্ষাকালে দ্বিগুণ হয়।
বর্ষাকালে পানি বাড়লে তলদেশও অনেক নিচে নেমে যায়। এই প্রাকৃতিক চত্বরে মাওয়ার কাছে পদ্মার গভীরতা দ্বিগুণ। পৃথিবীর কোথাও এত গভীরতায় সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়নি।
এছাড়াও নদীর তলদেশে কোন পাথর নেই, সমস্ত আলগা মাটি, বালি, সিল্ক পলিমাটি। এর ক্ষমতা হল এটি ক্রস ভেঙ্গে নীচে বর্গক্ষেত্র করতে পারে। মাওয়া স্থান নির্বাচন করার কারণ হলো, লক্ষাধিক বছর আগে এখানে সুন্দরবনের মতো একটি বন ছিল, যেখানে গাছগুলো পরবর্তীতে নির্জন পাথুরে স্তর রয়েছে। এ সুবিধা নিতে মাওয়ায় চূড়ান্ত স্থান নেওয়া হয়েছে।
আমরা নদীকে মারিনি। পদ্মায় প্রবাহটা প্রবাহিত হয় মাত্র দুই থেকে তিন কিলোমিটার। আমরা গত দেড় থেকে দুইশত বছরের হিসেব কষে দেখেছি ১২ বছরের মধ্যে পদ্মা জায়গা পরিবর্তন করে। তবে তা ৬ কিলোমিটারের মধ্যে। আমরা সেতু নির্মাণ করতে পারতাম তিন কিলোমিটার লম্বা কিন্তু এটা বিপজ্জনক হতো, কারণ নদী এটা মানতো না। তাই আমরা পদ্মা সেতু ৬ কিলোমিটার করলাম। কিন্তু অ্যাপ্রোচরোডসহ গোটা সেতুর দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ১৫ কিলোমিটার।
আমি নদীতে কাজ করেছি, তাই আমরা বোঝার চেষ্টা করেছি যে নদী কী চায়, এবং আমরা সেটাই করার চেষ্টা করেছি। সেতু দেখে নদী তার নিচে যেতে চায় না, পাশ দিয়ে যেতে চায়।
পদ্মা সেতুর কারণে ইলিশ মাছ যাতে রেগে না যায় সেজন্য গাদাগুলো মাফলার দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছিল। যাতে হাতুড়ি দিয়ে পেটানোর শব্দ হয়। পদ্মা সেতুর মেঝে দিয়ে ইলিশ মাছের যাতায়াত। শব্দ দুইশ দশমিকের উপরে হলে ইলিশ মাছ উল্টো দিকে চলে যায়। আমাদের বলা হয়েছে, যেখানে নদীর গভীরতা ৩০ ফুটের বেশি সেখানে মৎস্য মন্ত্রণালয় যদি বলে ইলিশ মাছ যাচ্ছে, তাহলে কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইলিশ মাছের সময় কোনো কাজ করা হয়নি।
আমরা যখন সেতুর কাজ শুরু করি তখন এটি মাওয়া থেকে কাছাকাছি হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু এখন এটি ১ কিলোমিটার দূরে। কাজ করতে চাইলে ডিজাইন পরিবর্তন করতে হবে। পদ্মা সেতুর শুধু সেতু অংশের কাজ শেষ হয়েছে, নদী শাসনের কাজ শেষ হতে আরও এক বছর সময় লাগবে।
আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মূল বক্তা হিসেবে অনলাইনে ছিলেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর মোঃ ছাদেকুল আরেফিন, ভারতের জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক ড. সঞ্জয় কে. ভরদ্বাজ।
সভাপতির বক্তব্যে প্রফেসর ড. মোঃ ছাদেকুল আরেফিন বলেন, পদ্মা সেতুর প্রভাবে দক্ষিণাঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটবে। যা এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাবে। আগামীতে বরিশাল হবে দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম বাণিজ্যিক ও শিল্পনগরী।
প্রসঙ্গত, পদ্মা সেতু তৈরী বিষয়টি সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ন তথ্য অনেকের জানা নেই। প্রকৃত অর্থে সেতুটি তৈরী করা খুব কঠিন ছিল। অনেক চ্যালেঞ্জ মুখে পড়তে হয়েছে সেতুটি তৈরী করতে এমনটি মন্তব্য করে বিশেষাজ্ঞরা।