সরকারবিরোধী আন্দোলনের সফলতা নিয়ে আশাবাদী হতে পারছেন না বিএনপির তৃণমূল নেতারা। কর্মসূচির সফলতায় কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ের অভাবও দেখা যাচ্ছে। তাদের মতে, হাইকমান্ডের নাম ব্যবহার করে আন্দোলনকে সঠিক পথে নিতে দিচ্ছেন না সংশ্লিষ্ট কয়েকজন নেতা। এছাড়া নির্বাচনের আগে আত্মগোপনে যাওয়া অনেক নেতা এখনো কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে অনেকের কাছে।
এমন পরিস্থিতিতে আবারো নতুন কর্মসূচির কথা ভাবছে বিএনপি। বিশ্ব ইজতেমা, এসএসসি পরীক্ষা, রোজা ও ঈদকে সামনে রেখে কর্মসূচি ঠিক করবে দলটি। একদলীয় দাবির পাশাপাশি শিগগিরই জন ইস্যুতে কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
দলের একাধিক নেতা জানান, আন্দোলনের এই সময়ে একটি ‘বিশেষ চক্র’ আবারও অঙ্গ সংগঠনের কমিটি ভেঙে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে নেমেছে। এ তিন সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের নামে নানা অপপ্রচারও চালাচ্ছেন তারা। কিন্তু জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটির মেয়াদ এখনো আছে। নেতারা বলেন, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই কমিটি ভেঙে দেওয়া হলে তা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কারণ চলমান আন্দোলনে প্রধান দল বিএনপির চেয়ে এসব সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ভূমিকাই বেশি দৃশ্যমান ছিল। এখন কমিটি ভেঙ্গে গেলে তাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। নেতাকর্মীরা মনোবল হারাবেন। যা ভবিষ্যতে আন্দোলনকে প্রভাবিত করতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ওই বিশেষ মহলের উদ্দেশ্য বা কার এজেন্ডা নিয়ে তারা এসব করছেন তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন নেতারা। এ নিয়ে অঙ্গ সংগঠনে ক্ষোভ রয়েছে।
এদিকে সতের বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। দলটি এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে আন্দোলন করে আসছে। এরই মধ্যে তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। দীর্ঘ আন্দোলন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছায়নি। এ জন্য দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের দায়িত্ব পালন করছেন তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। আন্দোলনের অংশ হিসেবে জনগণ বয়কটের ডাকে সাড়া দিলেও বিএনপি নেতারা বলছেন, এটা তাদের বড় সাফল্য। তারা গণতন্ত্র ও মানুষের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য আন্দোলন করছে। এ দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে থাকবে।
একদলের আন্দোলনে ধারাবাহিক কর্মসূচি ঘোষণা করেও কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠে নামেন না বলে অভিযোগ তরুণ নেতাকর্মীদের। শীর্ষ নেতাদের অধিকাংশই আত্মগোপনে ছিলেন। কর্মসূচি বাস্তবায়নে কোনো সমন্বয় ছিল না। সঠিক সময়ে তাদের কোনো বার্তা দেওয়া হয়নি। একের পর এক কর্মসূচি ঘোষণা করলেও গ্রেপ্তার এড়াতে সক্রিয় নেতাদের আত্মগোপনের ‘ভিত্তিহীন’ বার্তা দিয়েছে দলীয় হাইকমান্ড। এখন অনেকেই বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন। তাদের দাবি, কেন্দ্রীয় নেতারা গোপনে বহুবার বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন। যদিও সরকারবিরোধী আন্দোলনের ব্যর্থতার দায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা দেখছেন না। তারা বলছেন, দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। শীর্ষ ও কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেফতার করা হলে সরকারবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না।
জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী যুগান্তরকে বলেন, ‘একদফার আন্দোলনে তৃণমূলের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতাদের কোনো সমন্বয় ছিল না, বিষয়টি সঠিক নয়। সরকার এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করেছে, তার মধ্যেও জুমে আমাদের শীর্ষ নেতারা নিয়মিত যোগাযোগ করেছেন। তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে সার্বিক বিষয়ে কথা বলেছেন। আমাকেও কর্মসূচি ঘোষণা করতে হয়েছে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও কর্মসূচি পালন করেছি।’
তিনি বলেন, ‘যেখানে দেখামাত্রই গ্রেফতার করা হচ্ছে। সরকার নিজেরা নাশকতা করে বিএনপি নেতাদের নামে মামলা দিয়েছে। এমন বীভৎস দমনপীড়নের মধ্যে সর্বোচ্চ যতটুকু পারা যায়, শীর্ষ নেতারা তা রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। এখন পর্যন্ত কেউ কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়হীনতার বিষয়ে অভিযোগ করেননি। তারা (তৃণমূল) মনে করে, সরকারের দমনপীড়নের কারণে একদফার আন্দোলন কিছুটা গতি কমেছে। এটা আবার গতিশীল হবে। সর্বশেষ ৩০ জানুয়ারি কালো পতাকা মিছিলেও সরকার তাণ্ডব চালিয়েছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খানকে হেনস্তা করেছে। তারপরও আন্দোলন থেমে নেই। আন্দোলন চলছেই।’
তৃণমূল নেতাদের অভিযোগ, ২৮ অক্টোবরের পর তারা লাগাতার কর্মসূচি ঘোষণা করলেও অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতাকে পাশে পাননি। সরকারবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে সমন্বয়হীনতার কারণে তাদের অনেকেই নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। গ্রেফতার, মামলা ও হামলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তৃণমূল নেতারা। যাদের অনেকেই এখনও এলাকার বাইরে। জেলা ও মহানগরে কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রুপিংয়ের কারণে অনেকেই মাঠের কর্মসূচি থেকে নিজেদের দূরে রেখেছেন। কেউ কেউ ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের আশীর্বাদ করেছিলেন।
কোনো কোনো জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা প্রায় একইভাবে বলেছেন, ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টন মহাসমাবেশ পণ্ডের পর কেন্দ্রীয় নেতারা আত্মগোপন করেছেন। জেলা ও মহানগরের দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় নেতাদেরও এ সময় পাওয়া যায়নি। উল্টো হরতাল-অবরোধের ধারাবাহিকতায় গ্রেফতার এড়াতে মাঠে সক্রিয় নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। অনেকে আন্দোলনের মাঠ ছেড়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন। এছাড়া তৃণমূলের সঙ্গে কোনো সমন্বয় ছাড়াই কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। এক পক্ষের আন্দোলনে যেসব কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে সেগুলো বাস্তবে কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব তা দেখা যায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তৃণমূলের আরও বেশ কয়েকজন নেতা জানান, শীর্ষ নেতাদের অনেকেই শুধুমাত্র জুম মিটিংয়ে সীমাবদ্ধ ছিলেন। ফলে হরতাল-অবরোধে তৃণমূল কর্মীদের ছাড়া শীর্ষ নেতাদের দেখা যায়নি। সবাই বলেছেন, আন্দোলনের ওপর নজর রাখা হচ্ছে। সবাই মনিটরিং করায় তারা মাঠের কর্মসূচিতে ছিলেন না। কর্মীরা নিজেরাই বিভিন্ন ঝুঁকি নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে কর্মসূচি পালন করেন। দল কোনো কর্মসূচি দিলে শুধু কর্মীরা তা বাস্তবায়ন করে জীবন দেবে এমনটা হতে পারে না। অনেক কেন্দ্রীয় নেতা এলাকায় যাননি। তারা এখনো ঢাকায় আত্মগোপন করে আছে। তবে তারা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ বলেও জানান। যে কোনো মূল্যে তিনি যে নির্দেশনা দেবেন তা তারা বাস্তবায়ন করবে। তবে উপযুক্ত নেতাকে সঠিক দায়িত্ব দিয়ে আন্দোলনকে আরও গতিশীল করার কথাও বলেছেন নেতারা।