সম্প্রতি সারা-দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচিত তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে একের পর এক উঠে আসছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। বর্তমানে যেদিকেই যাচ্ছেন সেদিকেই যেন বিপদ তাকে ঘিরে ধরছে। এদিকে ফোনালাপ ফাঁস ও জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের পর এবার প্রতিমন্ত্রী মুরাদের বিরুদ্ধে উঠে এসেছে নতুন আরেক অভিযোগ।
জানা গেছে, এই প্রতিমন্ত্রীর হাত থেকে রেহাই পাননি সচিবালয়ের কর্মকর্তারাও। বাজে ব্যবহারের শিকার হয়ে বলা যায় এক রকম বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন সরকারি কর্মকর্তারা।
এক নারীকে নিয়ে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের অশ্লীল মন্তব্যের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর একে একে তাঁর আপত্তিকর বক্তব্যের আরও কথোপকথন বের হতে শুরু করে। এর জেরে সারা দেশে জোর সমালোচনা শুরু হয়। বিএনপি তো বটেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নারী নেত্রীদের পক্ষ থেকেও তাঁর পদত্যাগের দাবি ওঠে। এ অবস্থায় তথ্য প্রতিমন্ত্রীকে পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করে মুরাদকে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন শেখ হাসিনা। ওই বছরের ২৯ মে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে মুরাদকে তথ্য প্রতিমন্ত্রী করা হয়। কর্মকর্তারা জানান, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় মুরাদকে তথ্য মন্ত্রণালয়ে বদলি করেন প্রধানমন্ত্রী।
তথ্য মন্ত্রণালয়ে আসার পরও মুরাদের একান্ত সচিব ছিল (পিএস)। অকারণে পিএসের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করায় তিনিও সরে যান। দেড় বছরের বেশি সময় ধরে পিএস পাচ্ছেন না তিনি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করায় তথ্য প্রতিমন্ত্রীকে আর কোনো পিএস দেওয়া হবে না বলে অলিখিত সিদ্ধান্ত নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর ২০১৯ সালের ৮ জানুয়ারি ওই সময়কার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মারুফ রশীদ খান এবং ২০১৯ সালের ২৫ জুন ওই সময়কার জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব মো. আলমগীর হোসেনকে মুরাদের পিএস নিয়োগ দেওয়া হয়।
এ ছাড়া মুরাদের অভিপ্রায় অনুযায়ী মো. দাউদ হোসেনকে ২০১৯ সালের ৩০ মে, রওশন চৌধুরীকে ২০২০ সালের ২২ অক্টোবর এবং ইমরান হোসাইন শরীফকে গত ১৪ জানুয়ারি এপিএস হিসেবে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এদের কেউই এখন আর প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে নেই। বর্তমানে মঞ্জুরুল রওশন চৌধুরী প্রতিমন্ত্রীর এপিএসের দায়িত্ব আছেন। তাঁর সঙ্গে জাহিদ নাইম ব্যক্তিগত সহকারীর দায়িত্ব পালন করছেন।
যেসব মন্ত্রণালয়ে একই সঙ্গে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন, সেখানে সাধারণত একজন জনসংযোগ কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে জনসংযোগ কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। তথ্য মন্ত্রণালয়ে আগে থেকে জনসংযোগ কর্মকর্তা থাকলেও প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর নিজের দপ্তরের জন্য জনসংযোগ কর্মকর্তা নিয়োগ দেন মুরাদ। তথ্য প্রতিমন্ত্রী হিসেবে এখন পর্যন্ত তিনি তিনজনকে জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়েছেন।
এক কর্মকর্তা জানান, পিএস হিসেবে কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে না পাওয়ায় জনসংযোগ কর্মকর্তাকে দিয়ে অনেক কাজ করান তথ্য প্রতিমন্ত্রী। এই কারণ ছাড়াও মুখের ভাষা ভালো না হওয়ায় কেউ তাঁর দপ্তরে থাকতে চান না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিমন্ত্রীর দফতরের সাবেক এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, তার ব্যবহার অত্যন্ত খারাপ ছিল। গালি কাকে বলে, তার সঙ্গে কাজ না করলে বুঝবেন না। মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘তোকে লা থি মারব’।
অন্য একটি ঘটনার ব্যাপারে ওই কর্মকর্তা বলেন, আরেকজনকে ফাইল দিয়ে মারার জন্য উদ্যত হন তিনি। বলেন, ‘তোকে আজ শেষ করে দেব।’
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না। কিন্তু তিনি সীমা লঙ্ঘন করেছেন। এজন্যই তার এমন পরিণতি— মনে করেন ওই কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রীর কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
এদিকে, বিতর্কিত মন্তব্য আর কল রেকর্ড ফাঁসের পর চারদিকে যখন সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই ঢাকা ছাড়েন প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. মুরাদ হাসান। সোমবার দুপুরে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়েন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রতিমন্ত্রী চট্টগ্রামের উদ্দেশে দুপুরেই ঢাকা থেকে রওনা হন। সেখানে তার এক বন্ধুর বাসায় ওঠার কথা। বর্তমানে তার ফোন বন্ধ রয়েছে। তাই তার সঠিক অবস্থান জানি না।
সোমবার সচিবালয়ে নিজ দফতরেও আসেননি প্রতিমন্ত্রী। এদিন বিকেল সাড়ে ৩টায় রাজধানীর তোপখানা রোডে অবস্থিত বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা থাকলেও সেখানে যাননি সরকারের এ প্রতিমন্ত্রী।
এদিকে এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের সঙ্গে মুঠো ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও, তার ব্যবহৃত ফোন নম্বরটি বন্ধ থাকায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। জানা গেছে, গতকাল রাত ৮ টার পরে রাজধাণী ঢাকা ত্যাগ করেছেন ক্ষমতাসীন দলের এই আলোচিত মন্ত্রী।