শেখ হাসিনার সরকারের পতন, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভসহ সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন ও অর্থমন্ত্রী ইয়েলেনকে চিঠি দিয়েছেন কংগ্রেসের ছয় সদস্য।
চিঠিতে শেখ হাসিনা সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এসব আইনপ্রণেতারা। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানান তারা।
গত বুধবার লেখা এই চিঠিতে কংগ্রেসের উভয় কক্ষ-সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদের এই সদস্যরা বলেছেন, হাসিনা সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে তারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। গত ১৫ জুলাই সরকারি চাকরিতে অন্যায্য কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমন করতে পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করে আওয়ামী লীগ। পরের সপ্তাহে, আইন প্রয়োগকারীরা বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অসম এবং অবৈধ বল প্রয়োগ করে। রাবার বুলেট, পেলেট, সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাসের শেল ও গোলাবারুদ ছোঁড়ে।
এ আইনপ্রণেতারা বলেন, এসব ঘটনা বিস্তৃত পরিসরে ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের চালানো দমনপীড়নেরই অংশ। নিজেদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় দলটির নেতাদের জবাবদিহির আওতায় আনা হয়নি। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, তবু তাঁদের জবাবদিহির প্রয়োজনীয়তা রয়ে গেছে।
এমন প্রেক্ষাপটে, কংগ্রেস সদস্যরা ওবায়দুল কাদের এবং আসাদুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কি হিউম্যান রাইটস অ্যাকাউন্টিবিলিটি অ্যাক্ট সহ সমস্ত প্রযোজ্য আইনের অধীনে সুনির্দিষ্টভাবে নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানিয়েছেন।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৫ জুলাই সহিংস দমনাভিযানের পর শেখ হাসিনা দেশজুড়ে কারফিউ জারি করেন। বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট যোগাযোগ। জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ এটিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন বলে মনে করে। আন্দোলনে বেশির ভাগ সহিংসতার জন্য দায়ী দুই বাহিনী—পুলিশ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এর দায়ভার আসাদুজ্জামান খানের।
এদিকে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালাতে ছাত্রলীগকে পাঠিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশও দেন তিনি। সহিংসতায় অন্তত ২০০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। নিহত ব্যক্তিদের প্রকৃত সংখ্যা সম্ভবত আরও বেশি। এ ছাড়া, পুলিশ ছাত্র আন্দোলনের নেতাদেরসহ ১০ হাজারের বেশি মানুষকে আটক–গ্রেপ্তার করে; নানা অভিযোগে আসামি করে দুই লাখ লোককে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভাষায়, এটি ছিল ‘উইচ হান্ট’। বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ আরেকবার বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন ও জোরপূর্বক গুমে জড়িয়ে পড়তে পারে বলে সতর্ক করে দেয় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
কংগ্রেস সদস্যরা জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলে ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগ বিক্ষোভকারীদের ওপর নিষ্ঠুর দমনপীড়ন চালায়। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালাতে ওবায়দুল কাদের ও আসাদুজ্জামান খান আবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দেন। এর ফলে সৃষ্ট সহিংসতায় ওই দিন প্রায় ১০০ মানুষ নিহত হন। শেখ হাসিনা আবার দেশজুড়ে কারফিউ জারি করেন এবং বন্ধ করে দেওয়া হয় যোগাযোগ ব্যবস্থা। এতে বাংলাদেশি–আমেরিকানরা তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে আরও একবার যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস অবিলম্বে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধে পদক্ষেপ নিতে বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়া ‘অসম্মানজনক কর্মকাণ্ডে’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে গেলেও ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের কোনো পরিণামের মুখে পড়তে হয়নি।
এই আইনপ্রণেতারা বলেন, “র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে সাফল্য এসেছে।” যাইহোক, বর্তমান বাস্তবতায় এটি যথেষ্ট নয়। ওবায়দুল কাদের ও আসাদুজ্জামানের ওপর সুনির্দিষ্টভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে প্রয়োগযোগ্য সব ক্ষমতা খাটিয়ে আওয়ামী লীগের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় শক্ত জবাব দেওয়ার আহ্বান জানাই আমরা। ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের আইনের আওতায় পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।’
চিঠিতে স্বাক্ষরকারী কংগ্রেসের সদস্যরা হলেন লয়েড ডগেট, এডওয়ার্ড জে মার্কি, উইলিয়াম আর কিটিং, ক্রিস ভন হলেন, জেমস পি ম্যাকগভার্ন ও অল গ্রিন।