সম্প্রতি দলীয় শৃঙ্খলা বঙ্গসহ নানা অভিযোগ উঠে বরিশাল বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনা্থের নামে। বিশেষ করে মেহেন্দীগঞ্জ মেয়রকে কোপানোর নির্দেশ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনায় আসেন এমপি পঙ্কজ দেবনা্থ। পরে এ বিষয়টি নিয়ে দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে আলোচনা হয়। সে কারনে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়ার হয়েছে বলে ধারনা করা হচ্ছে। তবে এবার তার সংসদ সদস্য পদ থাকবে কিনা তার প্রশ্ন উঠেছে নতুন করে।
বরিশাল-৪ আসনের এমপি পঙ্কজ নাথের (পঙ্কজ দেবনাথ) আসন কি শূন্য হতে চলেছে? গতকাল রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে এ নিয়ে ছিল আলোচনা। এর আগে এভাবে দলটি থেকে প্রথমে অব্যাহতি ও পরে বহিষ্কার হওয়ার পর এমপি পদ ছাড়তে হয়েছিল আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ দেশের একটি জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমকে
বলেন, পঙ্কজ দেবনাথ জনগণের ম্যান্ডেট নিয়েছেন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে। যুক্তি হিসেবে বলা যায়, দল বহিষ্কার করলে তার এমপি পদ থাকে না। কারণ তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে নেই। দল থেকে বহিষ্কার করা হলে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ এবং আরপিওর বিধি ১২(১) অনুযায়ী তাদের এমপি পদ থাকবে না। এখন দেখার বিষয় নির্বাচন কমিশন কীভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করবে। তিনি বলেন, যে দল তাকে মনোনয়ন দিয়েছে সেই দল যদি তার পদ হারায় তাহলে সংসদে তার অবস্থান কোথায় থাকবে? এখন অন্য দলে যোগদান বা স্বতন্ত্র এমপি হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার শর্ত পূরণ করেননি। সব কিছুর পরও পঙ্কজ দেবনাথ এমপি থাকবেন কি থাকবেন না সে বিষয়ে সংসদ ও নির্বাচন কমিশনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে বলে মনে করেন এই আইনজীবী।
গত সোমবার বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের দলীয় সব পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত অব্যাহতি পত্রে উল্লেখ করা হয়- ‘আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী সংসদ সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী অর্পিত ক্ষমতাবলে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে আপনাকে আওয়ামী লীগ বরিশাল জেলা শাখার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য পদসহ দলীয় অন্য সব পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান করেছে। উক্ত বিষয়ে আপনার লিখিত জবাব আগামী ১৫ দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় দফতর বিভাগে জমা প্রদান করার জন্য সাংগঠনিক নির্দেশক্রমে অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।’
আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে এমপি পঙ্কজ দেবনাথের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ। তার বিরুদ্ধে বিগত চার বছরে দলীয় নেতা-কর্মীদের হ/ত্যা, নির্যাতন, পঙ্গু ও হয়রানি করে দলে বিভক্ত করে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য নিজস্ব বলয় তৈরির অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে ইউপি নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করা এবং নৌকা হারানোর অভিযোগ রয়েছে। নির্বাচনী এলাকায় প্রতিটি সংগঠনকে আলাদা করে ‘এমপি লীগ’ গঠনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সর্বশেষ জেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে বিরোধে জড়ান বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ফোরামে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ক্ষুব্ধ।
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দল থেকে বহিষ্কৃত হলে তিনি সংসদ সদস্য পদ হারাবেন এমন কোনো স্পষ্ট ইঙ্গিত নেই। তবে দল তাকে বহিষ্কার করলে তিনি সংসদ সদস্য পদ হারাতে পারেন।
সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হওয়ার বিষয়ে সংবিধানের ৬৭ অনুচ্ছেদে বেশ কিছু বিধান রয়েছে। এর মধ্যে ৬৭(১)(ঙ) এ বলা হয়েছে, ‘কোন সংসদ-সদস্যের আসন শূন্য হইবে, যদি এই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বর্ণিত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।’ আর আসন শূন্য হওয়ার বিষয়ে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি- (ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোন নির্বাচনে সংসদ-সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।’
গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের ১২(১)খ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইবার বা থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি তিনি কোন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল কর্তৃক মনোনিত না হন বা একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী না হন।’
এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক দেশের একটি জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “দল যদি একজন সংসদ সদস্যকে বহিষ্কার করে, তাহলে তার সদস্যপদ কী হবে তার উত্তর আমাদের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সরাসরি নেই। ৭০ অনুচ্ছেদে দল থেকে পদত্যাগ বা দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার বিষয়ে বলা আছে। বহিষ্কারের বিষয়টি নিয়ে মামলা হলে তখন উচ্চ আদালত এ বিষয়ে নির্দেশনা দিতে পারেন। তবে আমার ধারণা শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা দাঁড়াবে পদত্যাগ ও বহিষ্কার শব্দটা সমর্থক কি-না। হাই কোর্ট হয়তো এটাই বলবেন যে, দল থেকে পদত্যাগ করা আর বহিষ্কার করা সমর্থক। তাহলে এই বিবেচনায় তার সংসদ সদস্য পদ থাকবে না। তবে হাই কোর্ট কী বলবেন সেই সিদ্ধান্তের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সংসদ সদস্য হওয়ার পর থেকে বরিশালের হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলায় দলীয় রাজনীতিতে মানিয়ে নিতে পারছেন না পঙ্কজ নাথ। তিনি দুই উপজেলাসহ প্রতিটি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটি করে নিজস্ব বলয় গড়ে তোলেন। এ নিয়ে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন। এই দূরত্ব শেষ পর্যন্ত সংঘর্ষে রূপ নেয়। কেন্দ্রে পাঠানো লিখিত রেজুলেশনে অভিযোগ করা হয়, পঙ্কজ নাথ তার নির্বাচনী এলাকা হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলায় দলের অভ্যন্তরে বিভেদ সৃষ্টি করতে পুরনো ও ত্যাগী নেতা-কর্মীদের কোণঠাসা করে রেখেছেন। একই সঙ্গে তারা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কেন্দ্রীয় দলীয় প্রার্থীদের বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থী দিচ্ছেন, দলীয় প্রার্থীদের পরাজিত করতে খু/ন করছেন, দলীয় নেতা-কর্মীদের মারধর, ক্ষত-বিক্ষত ও সিনিয়র নেতাদের লাঞ্ছিত করছেন।
১৭ সেপ্টেম্বর হিজলা ও ১৮ সেপ্টেম্বর মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা সম্মেলন সংঘাতের আশঙ্কা করে কেন্দ্রে পাঠানো রেজল্যুশনে জেলা আওয়ামী লীগ দাবি করে, পঙ্কজ নাথকে দলীয় পদে রেখে ওই দুই উপজেলায় সম্মেলন করা হলে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা হতে পারে। দলের পুরনো ও ত্যাগী নেতা-কর্মীরা যোগ্য পদ পাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেন। সর্বশেষ ২৮ আগস্ট মেহেন্দীগঞ্জ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ঢুকে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ছয় নেতা-কর্মীকে কুপিয়ে আহত করার ঘটনাও এতে উল্লেখ করা হয়।
প্রসঙ্গত, নানা অভিযোগের কারনে অবশেষে তাকে অব্যাহতি দেওয়ায় পরিপ্রেক্ষিতে তার সংসদ সদস্য থাকা নিয়ে এখন আলোচনা চলচ্ছে। তবে শেষ পর্যন্ত কি তাকে সংসদ সদস্য পদ থেকে বাদ পড়তে হবে।