একসময় দেশের নামকরা জনপ্রিয় ব্যাংক ছিল ইসলামিক ব্যাংক। মানুষের আস্থার প্রতীক ছিল এই ব্যাংকটি। কিন্তু মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে দৃশ্যপট। ইসলামী ব্যাংক নিয়ে একের পর এক আলোচিত সমালোচিত্র ঘটনা ঘটেই চলছে বাংলাদেশ। একে পর একবার তথ্য বেরোচ্ছে এই ব্যাংকটির বিরুদ্ধে। এবার জানা গেল ভিন্ন এক খবর। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা ধার নিয়ে চলেছে এই ব্যাংকটি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে দৈনিক নগদ জমার হার (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমার (এসএলআর) হার সংরক্ষণে ঘাটতিতে পড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আট হাজার কোটি টাকা ধার নেয় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ; যেজন্য ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদ গুনতে হয় ব্যাংকটিকে।
আমানত কমে যাওয়ায় তারল্য সংকটের কারণে বছরের শেষ কার্যদিবস ২৯ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার ‘ডিমান্ড প্রমিসরি নোট’-এর বিপরীতে বিশেষ ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে এই পরিমাণ টাকা নেয় শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মাজবাউল হক সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশকে (আইবিবিএল) ঋন দেওয়া হয়েছে। পরের কার্যদিবসে ওই আট হাজার কোটি টাকা সমন্বয় করে ব্যাংকটি।
সম্প্রতি নিয়ম না মেনে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে বড় ধরনের ঋণ দিয়ে আলোচনায় আসা শরিয়াহভিত্তিক আইবিবিএল বেশ কিছুদিন ধরে তারল্য সংকটে রয়েছে। পাশাপাশি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকেও বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যবেক্ষক নিয়োগ করেছে।
ঋণের অনিয়ম ও মনিটরিংয়ের খবর প্রকাশের পর, গ্রাহকরা গুজবের মধ্যে আইবিবিএল থেকে আমানত উত্তোলন অব্যাহত রেখেছেন। সিআরআর এবং এসএলআর বজায় রাখার জন্য ব্যাঙ্কের উপর চাপ রয়েছে। পরে বৃহস্পতিবার দৈনিক সুদের ভিত্তিতে ঋণের জন্য আবেদন করতে বাধ্য হয়, যা বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন করে।
এ বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম আইবিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মাওলার কার্যালয়ে গিয়ে একাধিকবার ফোন ও এসএমএসে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি অনুসারে, শরিয়াহ-ভিত্তিক ব্যাংকগুলিকে মোট আমানতের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ হিসাবে দৈনিক ন্যূনতম ৩ শতাংশ এবং দ্বি-সাপ্তাহিক ৪ শতাংশ সিআরআর (ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও) বজায় রাখতে হবে।
এছাড়া আমানতের সাড়ে ৫ শতাংশ ‘বিশেষ সংবিধিবদ্ধ আমানত-এসএলআর’ হিসেবে রাখতে হবে। এ দুটি ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শাস্তির মুখে পড়তে হয় ব্যাংকগুলোকে।
বছরের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবার উভয় ক্ষেত্রেই আইবিবিএল-এর ঘাটতি থাকলে সঙ্কট ও জরিমানা এড়াতে ব্যাংক ‘ডিমান্ড প্রমিসরি নোট’ সিস্টেমের আশ্রয় নেয়। এ ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদ গুনতে হয়। ব্যাঙ্ক রাতারাতি বা একদিনের জন্য ৮ হাজার কোটি টাকা চার্জ করে।
শরীয়াহ-ভিত্তিক ব্যাংকিং নীতিতে পরিচালিত ইসলামী ব্যাংকগুলো সুদের পরিবর্তে মুনাফা দেয়, যার হার বছর শেষে চূড়ান্ত করা হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একদিনের ঋণের হার ছিল ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ, যা নির্ধারণ করা হয়েছে।
তাদের নিজস্ব নীতি অনুসারে, শরিয়াহ-ভিত্তিক ব্যাংকগুলি সুদ বা নির্দিষ্ট হারের মুনাফার বিপরীতে কোনো প্রকার আমানত সংগ্রহ বা ধার নিতে পারে না।
যাইহোক, ইসলামী ব্যাংক যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একদিনের জন্য ৮,০০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল, তখন প্রচলিত ব্যাংকগুলির জন্য সর্বোচ্চ রাতারাতি বা একদিনের সুদের হার ছিল ৬.২৫ টাকা, তিন দিনের জন্য ৮ টাকা এবং চার দিনের জন্য ৮.৯৫ টাকা।
তারল্য সংকটের সম্মুখীন হয়ে ইসলামী ব্যাংকগুলো প্রচলিত ব্যাংকের চেয়ে বেশি সুদে টাকা ধার করেছে। এছাড়া অনেক সূচকে সবচেয়ে বড় এই বেসরকারি ব্যাংকের জন্য অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নগদ ঋণ নেওয়ার আরেকটি পদ্ধতিও ব্যাংক এর আগে গ্রহণ করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, ব্যাংক ইতিমধ্যে সুকুক বন্ডের মাধ্যমে টাকা নেওয়ার সুযোগ ব্যবহার করেছে।
আবার, বাংলাদেশ ব্যাংকের নগদ চাহিদা মেটাতে শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো অন্যান্য প্রচলিত ব্যাংকের মতো রেপোতে ঋণ নেওয়ার সুযোগ নেই। যার কারণে ব্যাংকের কাছে ‘ডিমান্ড প্রমিসরি নোট’ নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।
ইসলামী ব্যাংকের মুদ্রাবাজার থেকে ঋণ গ্রহণের সুবিধার্থে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি দেশে প্রথমবারের মতো ইসলামিক ব্যাংক লিকুইডিটি ফ্যাসিলিটি (আইবিএলএফ) চালু করেছে। সরকারের ইসলামিক সুকুক বন্ডে (বিজিআইএস) বিনিয়োগ জামানত হিসেবে রেখে ইসলামী ব্যাংকগুলো এই তহবিল থেকে অর্থ ধার করতে পারবে। তবে এই বাজার থেকে ঋণ নেওয়ার সামর্থ্য বা সীমাও শেষ হয় ইসলামী ব্যাংকের।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ইসলামী ব্যাংক গত ডিসেম্বরে আসা রেমিটেন্সের একটি অংশ বিক্রি করে রোববার নগদ অর্থ সংগ্রহ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ঋণ ফেরত দিয়েছে।
এর আগে ঋণ অনিয়মের মামলায় আলোচনায় থাকা ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ তারল্য সংকটের কারণে একটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে সুদের হার ৮ শতাংশে উন্নীত করে আমানত পাওয়ার প্রস্তাব দেয়।
প্রসঙ্গত, গেলে বেশ কিছু মাস আগে সর্বপ্রথম এই ব্যাংকটির জালিয়াতির সম্পর্কে খবর প্রকাশ পায় গণমাধ্যমে। যেখানে শোনা যায় বেশ কয়েকজন ব্যক্তি মিলে ইসলামী ব্যাংকের মোট অংকের একটি টাকা পাচার করেছে বিদেশে। আর সেই থেকে এই ব্যাংকের পতন শুরু। এই ব্যাংক নিয়ে সরকার ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও এখনো সেগুলো রয়ে গেছে কাগজে-কলমে।