ক্ষমতার অপব্যবহারের চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না প্রবাসীদের নিয়ে গঠিত চতুর্থ প্রজন্মের এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংক। ঋণ কেলেঙ্কারিসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে পাঁচ বছর আগে ব্যাংকটিতে হস্তক্ষেপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অনিয়মের সহযোগী হওয়ায় ওই সময় ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীকে অপসারণ করা হয়। ব্যাংকের চেয়ারম্যানসহ নীতিনির্ধারণী সব পদেই এসেছে আমূল পরিবর্তন। পারভেজ তমাল প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ফরাসত আলীর স্থলাভিষিক্ত হয়ে ব্যাংক সংরক্ষণের দায়িত্ব নেন।
দায়িত্ব নেওয়ার পর, রক্ষক ভক্ষক হয়ে যায়। প্রভাবের মাধ্যমে ঘনিষ্ঠদের মধ্যে ঋণ বিতরণ; পৃথক প্রতিষ্ঠান খোলার মাধ্যমে ব্যাংকের নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ; তার বিরুদ্ধে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ, পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন, অনুগতদের বিও অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অর্থ পাচারসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে পারভেজ তমালের অনিয়মের বিষয়টি বেরিয়ে আসে। কিছু অভিযোগ দুদকও তদন্ত করছে। বেসামাল ব্যাংককে অনিয়ম থেকে বাঁচাতে তমালের নেতৃত্বাধীন এনআরবিসি ব্যাংকের বোর্ড ভেঙে দেওয়ার সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে অজ্ঞাত কারণে তা এখনো নথিপত্রেই সীমাবদ্ধ বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
এনআরবিসি ব্যাংকের দায়িত্ব নেওয়ার পর পারভেজ তমাল প্রথমে ব্যাংকের জনবল নিয়োগ শুরু করেন। এ জন্য তিনি এনআরবিসি ব্যাংক নামে একটি পৃথক প্রতিষ্ঠান খোলেন, যার নাম তিনি এনআরবিসি ম্যানেজমেন্ট রাখেন। জানা গেছে, এনআরবিসি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ২৬ এপ্রিল ২০২২ পর্যন্ত এনআরবিসি ব্যাংকে ৩ হাজার ৭১৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও, এনআরবিসি ব্যাংকের শাখা, উপ-শাখা এবং এটিএম, বিআরটিএ, এসআরও বুথে অভ্যন্তরীণ এবং সরঞ্জাম সরবরাহে ল্যান্টা সার্ভিসেস এবং টিএসএন ট্রেড অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের অর্থ অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি এখন তদন্তাধীন। দুদকের প্রধান কার্যালয় এসব অনিয়ম খতিয়ে দেখছে।
এনআরবিসি ব্যাংক জানায়, পারভেজ তমাল রিলায়েবল বিল্ডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত।
অভিযোগ, কাগজে কলমে কোম্পানিটি শফিকুল আলম নামে এক ব্যক্তির ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হলেও এটি মূলত পারভেজ তমালের একটি বেনামী কোম্পানি। পারভেজ তমালের বিভিন্ন খাতের অবৈধ অর্থ বেনামে বিনিয়োগ করা হয় রিলায়েবল বিল্ডার্সে।
এনআরবিসি ব্যাংকের হাতিরপুল শাখাও চেয়ারম্যানের স্বার্থে নামমাত্র জামানতে রিলায়েবল বিল্ডার্সকে ৩৩৭ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। এ ঋণের বিপরীতে বন্ধকের মূল্য মাত্র ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। বর্তমানে বিশেষ ব্যবস্থায় ঋণ নিয়মিত করা হচ্ছে।
পারভেজ তমালের বিরুদ্ধে সর্বশেষ অভিযোগ হলো শেয়ার কেলেঙ্কারি। বিএসইসি ও দুদকের তথ্য অনুযায়ী, পারভেজ তমালের বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) অ্যাকাউন্ট এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শেয়ার কারসাজি হয়েছে। কারসাজিতে জড়িত সন্দেহজনক অ্যাকাউন্টধারীরা হলেন তমাল পারভেজ, তমালের বাবা সৈয়দ শাহজাহান, তমালের স্ত্রী আসমা রশিদ, আসমার বাবা আবদুর রশিদ, তমালের ভাই সৈয়দ সাব্বির আহমেদ, তমালের পিএস আসিফ ইকবাল, আসিফের স্ত্রী এবং এনআরবিসি ব্যাংক ধানমন্ডি শাখার জুনিয়র অফিসার তাকিয়া ইসলাম নিশি। কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি মো. আদনান ইমামের বাবার নাম চৌধুরী ফজলে ইমাম। লেনদেনে চেক ব্যবহারের নিয়ম থাকলেও এই বিনিয়োগকারীরা নগদ অর্থ উত্তোলন করেছে, যা পুঁজিবাজার আইনের লঙ্ঘন। এভাবে তোলা অর্থ পাচার হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখছে দুদকসহ বিভিন্ন তদন্ত সংস্থা। এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ার সীমার বেশি বিনিয়োগের অপরাধে ব্যাংকটি ইতিমধ্যে ২৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, “এগুলো অনেক পুরোনো বিষয়। হঠাৎ এসব নিয়ে আন্দোলন কেন? এগুলো নিয়ে বলার কিছু নেই।
তবে ২০২২ এবং ২০২৩ সালের তদন্ত এবং তার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট চিঠি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন যে তিনি এগুলি সম্পর্কে অবগত নন।
এনআরবিসি ব্যাংকের বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক বলেন, “ব্যাংকিং খাতের সমস্যা শুধু ব্যাংকের কারণে হয় না। সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন ও নীতিমালা দিয়ে অনিয়ম বন্ধ করা কঠিন।