সাম্প্রতিক সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের এক বক্তব্যে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। তার এই ধরনের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তারই দলের অনেক শীর্ষ নেতা বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করেছেন। এমনকি তিনি আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির কেউ নন এমন ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। তার এই ধরনের কথা বলার অধিকার নেই বলেও জানিয়েছেন। তবে তিনি এবার তার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বললেন ভিন্ন কথা, যেটা নিয়েও শুরু হয়েছে সমালোচনা।
আর্কিমিডিসের সূত্রে বলা হয়েছে যে ‘যখন কোনো বস্তুকে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে একটি স্থির তরল বা বায়বীয় পদার্থে নিমজ্জিত করা হয়, তখন বস্তুটির কিছু বস্তুটি কিছু ওজন হারায় বলে মনে হয়। এই হারানো ওজন বস্তু দ্বারা স্থানচ্যুত তরল বা গ্যাসের ওজনের সমান।’ গ্রীক দার্শনিক আর্কিমিডিস খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে এই সূত্র আবিষ্কার করেন। এখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ‘সত্য-মিথ্যার’ এর উপর একটি ডিজিটাল সুত্র উদ্ভাবন করেছেন। তার আবিষ্কৃত সূত্র হলো, কারো বক্তব্য নিয়ে যদি বেশি বিতর্ক হয় এবং গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ ও বিতর্কের ঝড় ওঠে, তাহলে সেই বক্তব্য আপনাআপনিই বিপরীতরুপ (ডাহা মিথ্যা) ধারণ করে।
ড. এ কে আবদুল মোমেনের মতো রসায়নের শিক্ষার্থীরা গতকাল সচিবালয়ে তার নতুন আবিষ্কৃত ডিজিটাল সূত্রে বলেছেন, “আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার ধারে কাছেও আমি নই। এটা মিথ্যা। ভারতের কাছে শেখ হাসিনা সরকারকে টিকিয়ে রাখতে হবে এমন কোনো অনুরোধ করেননি। সরকার। আসলে ইউ”টিউবে তার ভাষণের রেকর্ডিং আছে। যে কেউ গুগলে গিয়ে ১৮ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠানে তার বক্তৃতা শুনতে পারেন।
গতকাল মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যাচার। আমি নির্বাচনের কথা বলিনি। তাহলে কি বললেন? সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার অস্থিতিশীল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমি স্থিতিশীলতার কথা বলেছি।
এর আগে ১৮ আগস্ট সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরীর জেএমএসইএন হলে হিন্দুদের জন্মাষ্টমী উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে যা যা করা দরকার ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছি। তিনি আরও বলেন, “আমি ভারতে গিয়ে বলেছিলাম, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। শেখ হাসিনা আমাদের রোল মডেল। তাকে টিকিয়ে রাখতে পারলে আমাদের দেশ উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাবে এবং সত্যিকারের সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক দেশে পরিণত হবে। সেজন্য আমি ভারত সরকারকে শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার তা করার অনুরোধ করেছি।
‘ভারতের সাহায্য চাওয়া’ বক্তব্য নিয়ে বিতর্কের মুখে পরদিন তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘আমি জেনেশুনে ভারতের কাছে সাহায্য চাওয়ার কথা বলেছি। আমি আমার বক্তব্য থেকে নড়ছি না। আমি ভুল কিছু বলিনি। আমরা স্থিতিশীলতা চাই। আমাদের বন্ধুরাও এটা চায়। এর জন্য আমার যা যা বলার দরকার আমি বলেছি। আমি ভুল কিছু বলিনি। নাথিং রং ইট। আমি আরও বলব। তাদের সহযোগিতা আমাদের দরকার।
দেশের জনগণের ভোটের পরিবর্তে নির্বাচনে ভারতের সাহায্য চাওয়ার এই বক্তব্যের পর সারা দেশে তোলপাড় শুরু হয়। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভারতের সহায়তায় ক্ষমতায় আসে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘বোমা ফাটানো’ বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গন এমনকি আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন মহলে নানা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। দেশটির রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কূটনীতিকরা বলছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলেছেন তা দেশের জন্য অসম্মানজনক। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ভারতকে অনুরোধ করার মতো কোনো দায়িত্ব শেখ হাসিনা দেননি। ওই বক্তব্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নিজের। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আওয়ামী লীগের নন। দলে তার কোনো অবস্থান নেই। তিনি সরকারের মন্ত্রী। তাই তিনি যা বলবেন তা দলের বক্তব্য হতে পারে না। তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দলীয় সংসদ সদস্য। কিন্তু আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য না হওয়ায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সেই দায়িত্ব কাউকে দেয়নি, এমনকি তাকেও নয়, বিদেশে গিয়ে কিছু বলার জন্য। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা চাইলেও জিএম কাদের, আসম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না, রুহুল কবির রিজভী, গণদলের রেজা কিবরিয়া, নুরুল হক নূর, এটিএম গোলাম মাওলা চৌধুরীসহ শতাধিক নেতা ড. তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা করার দাবি জানান।
এ কে আবদুল মোমেনের বক্তব্যে শপথ ভঙ্গ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে তার পদত্যাগ চেয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এরশাদ হোসেন। নোটিশে বলা হয়, “নোটিশ পাওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ড. এ কে আবদুল মোমেনকে মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। অন্যথায় আমি আপনার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হব।”
এর আগে তিনি দেশের মানুষ বেহেশতে আছেন বলে বিতর্ক সৃষ্টি করেছিলেন। পরে অবশ্য সাংবাদিকদের ওপর দোষ চাপিয়ে তিনি বলেন, আপনারা (সাংবাদিকরা) আমাকে খেয়ে ফেলেছেন? ‘দেশের মানুষ বেহেশতে আছে’ এই বক্তব্যের মতোই গতকাল গ্রীক দার্শনিক আর্কিমিডিসের মতো নতুন সূত্র ‘ডিজিটাল মিথ্যা’ আবিষ্কার করে ‘উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে’ প্রবাদটি চাপিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যে আভিযোগ আমি এই অভিযোগের ধারে কাছেও নেই।’ এখন প্রশ্ন হলো পররাষ্ট্রমন্ত্রী যদি এমন কথার ধারে কাছেও না থাকলে ইউটিউবে কার কণ্ঠ শোনা যায়? তাহলে যারা বিতর্ক করছেন তারা মিথ্যা বলছেন? এ যেন রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের দুই বিঘা জমির কবিতার অনুরুপ। ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ আমি আজ চোর বটে’।
উল্লেখ্য, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনকে এর আগেও সতর্ক করেছিলেন দলীয় নেতারা। তবে তিনি এবার ভিন্ন ধরনের কথা বলে বিতর্কিত হলেন। তিনি যে বিষয়টি তুলে ধরলেন সেটা হলো, ভারত সরকার বাংলাদেশের নির্বাচনে প্রভাব ফেলে থাকে তেমনই ইঙ্গিত দিলেন। তবে তার কথাবার্তায় আরো সংযত হতে হবে এমনটাই জানিয়েছেন অনেক নেতারা।