দেশে মহামারী ছড়িয়ে পড়ার থেকেই সারা দেশে তৈরী হয় একটি অস্থিতীকর পরিস্থিতি। আর সেই সময়ে দেশের এই মহামারীর হাল ধরার জন্য এগিয়ে আসে অনেক স্বাস্থ্যে খাত এবং হাসপাতাল গুলো। যার মধ্যে সব থেকে বেশি আলোচনায় ছিল জেকেজি এবং রিজেন্ট হাসপাতাল। আর সেই হাসপাতাল দুটিই এ নিয়ে সব থেকে বেশ দুর্নীতি করেছে। যার নেপথ্যে ছিল ডা. সাবরিনা আর শাহেদ। এ দিকে সাবরিনার টর্চার নিয়ে এবার মুখ খুলেছেন সেখানকার নিরাপত্তাকর্মী এনায়েত।
আমি তখনও ঘুম থেকে চিৎকার করছিলাম। স্বপ্নে জেকেজির লোকজন আমাকে ধারালো অস্ত্র ও রড দিয়ে মারছে। ক্ষতের চিহ্ন এখনো আছে, যা দিয়ে বিষ বের হয়।’
কথাগুলো বলেছেন সরকারি তিতুমীর কলেজের নিরাপত্তারক্ষী মো. এনায়েত হোসেন। ২ জুন, ২০২০ রাতে, জোবেদা খাতুন, কলেজের অন্যান্য চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের মতো, ইউনিভার্সাল হেলথকেয়ার বা জেকেজি হেলথকেয়ারের সদস্য এবং ভাড়াটেদের দ্বারা নির্মমভাবে লাঞ্ছিত হয়েছিল। পরে চিকিৎসার খরচ মেটাতে তিনি ৬০,০০০ টাকা ঋণ নেন, যা তাকে এখনও পরিশোধ করতে হবে। কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তিন হাজার টাকা নেওয়া ছাড়া এনায়েত আর কারও কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাননি।
২০২০ সালে, যখন দেশে করোনভাইরাস এর আতঙ্ক চরমে ছিল, জেকেজি হেলথকেয়ার করোনার নমুনা সংগ্রহের কাজ হাতে নেয়। নমুনা সংগ্রহের পর, সংস্থাটি ২৭,০০০ জনকে পরীক্ষা না করেই বানোয়াট রিপোর্ট দিয়েছে। এই অপরাধের মূলে ছিলেন জেকেজি হেলথকেয়ারের শীর্ষ কর্মকর্তা ডাঃ সাবরিনা ও তার স্বামী আরিফুল চৌধুরী। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় সাবরিনা ও তার স্বামীসহ ৮ আসামিকে ১২ বছর করে কারাদণ্ড দেন আদালত। বলা যায়, জেকেজি হেলথকেয়ার রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজকে এই অপরাধ সংগঠিত করার ‘ঘাঁটি’ বানিয়েছিল।
জেকেজি হেলথকেয়ার কৌশলগতভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রনলায়ের কাছ থেকে নমুনা পরীক্ষায় প্রযুক্তিবিদ এবং স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণের জন্য সরকারি তিতুমীর কলেজে একটি কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি পায়। দেশে করোনার হুমকি বিবেচনা করে কলেজ কর্তৃপক্ষও বিষয়টিকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু পরে জেকেজি হেলথকেয়ারের সদস্যরা কলেজ কর্তৃপক্ষকে জিম্মি করে সেখানে অপরাধের দৃশ্য তৈরি করে। অবাধে চলে মাদকসেবী পার্টি ও অসামাজিক কার্যকলাপ।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ও জনসাধারণের মধ্যে করোনা সংক্রমণের আতঙ্কে সারা ঢাকার মতো তিতুমীর কলেজ ক্যাম্পাসের পরিবেশ ছিল জনশূন্য। জেকেজি সদস্যরা কলেজ কোয়ার্টারে অবস্থানরত কয়েকজন কর্মচারী এবং নিরাপত্তা কর্মীদের চলাচলের উপর একটি অলিখিত নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করে। তারা যে ভবনে বসবাস করত সেখানে কাউকে ঢুকতে দিতে চায়নি। নিরাপত্তাকর্মীদের প্রবেশ নিয়েও আপত্তি ছিল। এমন পরিবেশ সৃষ্টি করে জেকেজি সদস্যরা দিনের পর দিন অপরাধ করে যাচ্ছে। কিন্তু কলেজ কোয়ার্টার পাশাপাশি হওয়ায় তাদের কর্মকাণ্ড কলেজের কর্মচারীদের কাছে অজানা ছিল না।
কলেজের বেশ কিছু নিরাপত্তা কর্মী এবং কর্মচারী এখনও JKG-এর সেই কার্যকলাপগুলিকে প্রাণবন্তভাবে স্মরণ করতে পারেন। তারা জানান, প্রায় প্রতি রাতেই দেশি-বিদেশি মাদকের পার্টি চলত। সন্ধ্যার পর থেকেই ছিল জোরেশোরে নাচ-গান। সেসব অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন ড. সাবরিনা ও আরিফুল চৌধুরী। জেকেজির সদস্যদের মধ্যে ছেলে-মেয়েদের আলাদা ভবনে থাকার ব্যবস্থা করা হলেও তা মানা হয়নি। তিতুমীর কলেজের এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মহিলা জেকেজি সদস্য ছাড়াও পুরুষ জেকেজি সদস্যদের ভবনে আরও অনেক মেয়েকে দেখা যায়।
প্রথমে, জেকেজি হেলথকেয়ার কলেজে অস্থায়ী তাঁবু স্থাপন এবং নতুন ভবনটিকে আবাসন হিসাবে ব্যবহার করার অনুমতি পেয়েছে। কিন্তু পরে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অডিটোরিয়াম, কলা ভবনসহ কয়েকটি ভবনের জায়গা দখল করে নেয়। কলেজ কর্তৃপক্ষ এতে আপত্তি করলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মামলা করার হুমকি দেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এমনকি রমজান মাসেও তিতুমীর কলেজ সংলগ্ন ভবনের বাসিন্দারা উচ্চস্বরে গানবাজনা ও মাদক সেবনের পার্টিতে বিরক্ত হয়ে পড়েন। একের পর এক অভিযোগ আসতে থাকে।
একপর্যায়ে কলেজের কর্মচারীরা বিষয়টি নিয়ে কথা বললে জেকেজি সদস্যরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। অফিস সহকারী নুর-মোহাম্মদ সারাবাংলাকে বলেন, “আশেপাশের ভবনের বাসিন্দারা তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে অভিযোগ করছিল। তখন আমরা অসহায়। পরে আমরা গিয়ে তাদের বলেছি, এ কাজ না করতে। সে ক্ষিপ্ত হয়ে পরের দিন আমাদের মারধর করে।
২ জুন, ২০২০, জেকেজি সদস্যরা মধ্যরাতে তিতুমীর কলেজের কর্মচারীদের উপর হামলা চালায়। আক্রমণের জন্য বহিরাগত ভাড়াটেদেরও আনা হয়েছিল। খালি কলেজে কর্মচারীদের খুঁজে বের করে বাঁশ, রড, চাপাতি ইত্যাদি দিয়ে পিটিয়ে আহত করা হয়। নিরাপত্তা প্রহরী মো. কিছু জানার আগেই ওই রাতেই এনায়েত হোসেনের ওপর হামলা হয়।
তিনি অনেক দিন ফরিদপুর গ্রামের বাড়ি বোয়ালীমারীতে ছিলেন। হামলার রাতেই তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। কলেজ থেকে তলব করায় ভাড়া করা মোটরসাইকেলে করে অনেক কষ্টে বাড়ি ফেরেন। অনেক কষ্টে ক্লান্ত এনায়েত তার ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিল। ওই অবস্থায় দরজা ভেঙে তাকে মারধর করা হয়।
এনায়েত হোসেন কান্নাজড়িত কণ্ঠে সারাবাংলাকে বলেন, “তারা আমাদের খুঁজে বের করে মারধর করেছে। আমি কোয়ার্টারে ছিলাম। তারা আমার দরজা ভেঙ্গে আমাকে মারধর করে। আমি হাত-পা ধরে কান্নাকাটি করেছি। কিন্তু তারা শোনেনি। ছেলেরা আমাকে মারধর করার পর মেয়েরা এসে আবার আমাকে মারধর করে, এমনকি হাসপাতালে যাওয়ার সুযোগও দেয়নি।
পরে নিস্তেজ হয়ে পড়েন এনায়েত। পরে পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। চারদিন চিকিৎসার পর তাকে আবার কলেজে রেখে দেওয়া হয়। কলেজ ক্যাম্পাস স্থবির হয়ে পড়ে। আক্রান্ত অন্য সহকর্মীরা কেউ বিছানায়, কেউ কেউ আতঙ্কে পালিয়ে যান। এনায়েত একা চলতে পারে না। এভাবে চার-পাঁচ দিন কাটিয়ে বাড়ি চলে গেল।
বাড়ি ফিরে চিকিৎসা নেন। এর দাম প্রায় ৬০ হাজার টাকা। শরীর মোটামুটি সুস্থ হলে তিতুমীর আবার কলেজে যোগ দেন। কিন্তু ঋণের বোঝা এখনো টানতে হয়। এনায়েত কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তিন হাজার টাকা সহায়তা পেয়েছেন। অন্য কোথাও থেকে কোনো সাহায্য বা আশ্বাস পাওয়া যায়নি। যাইহোক, একটি সুবিধা আছে. শারীরিক অসুস্থতার কারণে এনায়েতকে নিরাপত্তারক্ষীর দায়িত্ব থেকে অফিস সহকারীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এটি শরীরকে কিছুটা বিশ্রাম দেয়।
নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে এনায়েতের মাসিক বেতন ১০ হাজার টাকা। বাড়িতে স্ত্রী ও তিন ছেলে। বড় ছেলে ফরিদপুরে অনার্স প্রথম বর্ষে। মেজ জন দশম শ্রেনীর ছাত্র এবং ছোট ছেলে ৫ম শ্রেনীর ছাত্র। মাত্র ১০ হাজার টাকা বেতনে তিন ছেলের লেখাপড়ার খরচ মেটানো কঠিন, ঋণের বোঝা গলায় বড়সড় হয়ে উঠেছে।
এনায়েত হোসেনের পরনের কাপড়ে ক্ষত দেখা গেছে। দাগ এবং দাগ একদিন অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। কিন্তু নিরপরাধ মানুষ যেভাবে অত্যাচারিত হয় এবং ভয়াবহ অর্থনৈতিক কষ্টের সম্মুখীন হয়, তা কি কখনো পরিবার ও সন্তানদের খরচ মুছে ফেলবে?
সাবির্না ও আরিফুল চৌধুরীর ১২ বছরের কারাদণ্ডের কথা শোনার পর এনায়েত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া উচিত ছিল। নির্দোষ হয়েও আমরা যে নির্যাতনের শিকার হয়েছি তার কোনো প্রতিবাদ দেখিনি। আমাদের অত্যাচারের কথা সবাই ভুলে গেছে কিন্তু আমাদের কষ্টের শেষ নেই।’
প্রসঙ্গত, বর্তমানে সাবরিনা রয়েছেন কারাগারে। তার নামে হয়েছে বেশ কয়েকটি মামলা। আর সেই সব মামলায় সাজাও পেয়েছেন সাবরিনা।