আমাদের সমাজে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যেগুলো আমরা আওনেকটাই অপ্রত্যাশিত হিসেবে নেই এবং খানিকটা অবাকও হই। কিছু কিছু ঘটনা এমন থাকে যেখানে হৃদয় বিদারক ঘটনা এবং কিছু অন্যরকম বিষয় থাকে যা সত্যি মানুষের মনকে আন্দোলিত করে তোলে।
ঘটনাটি প্রায় ৫ বছর আগের। আমার পেশাগত জীবনের অনন্য এক অভিজ্ঞতা । ছোট্ট শিশু আফরা। মাত্র ১ বছর ১ মাস বয়স। ছবিতে যে শিশুটিকে একজন নারীর কোলে দেখছেন সে-ই হচ্ছে সুন্দর টুকটুকে আফরা। কিন্তু সমস্যা হয়েছে আফরাকে নিজের সন্তান বলে দাবি করছেন ছবির দুইজন মা। এদের একজন পালক মা অন্যজন জন্মদাতা মা। আফরা যার কোলে তিনি হচ্ছেন পালক মা আর সামনে দাঁড়িয়ে যিনি কাঁদছেন (একটু লম্বাটে) তিনি হচ্ছেন আসল মা। ছোট্ট আফরাকে নিয়ে চট্টগ্রামের আদালত অঙ্গনে সেদিন বিকেলে হৃদয়ষ্পর্শী ঘটনার অবতারণা হয়েছিলো। বাদী, আসামী, তাদের আত্মীয় স্বজন, পুলিশ, কর্মচারী এমনকি উভয় পক্ষের আইনজীবীরাও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।
কি হয়েছে বলি। আফরার আসল বাবার নাম হচ্ছে আসলাম। হালিশহর সবুজবাগে পরিবার নিয়ে থাকেন। এই লোকটা একজন নেশাখোর এবং জুয়াড়ি। আফরার মা রুবিকে নেশার টাকার জন্য নির্যাতন করতো। স্বামীর এমন দশায় সংসার চালানোর জন্য রুবি গার্মেন্টসে চাকরি নেয়। চাকরির বেতন পেলে আসলাম টাকার জন্য চাপ দিতো। একসময় রুবি বিরক্ত হয়ে যায়। আসলামকে আর কোন টাকা দিবেনা বলে জানিয়ে দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে রুবিকে শাঁসায় আসলাম। বলে বেশি বাড়াবাড়ি করলে বাচ্চাকে বিক্রি করে নেশার টাকা যোগাড় করবে।
বিগত ২৫ এপ্রিল, ২০১৭ ইংরেজি তারিখে বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে রুবি ঘুম থেকে উঠে দেখে পাশে থাকা বাচ্চা নেই। পাগলের মতো খুঁজতে থাকে তার একমাত্র সন্তানকে। কোথাও খুঁজে পায়না। আসলামকে ফোন করে তার মোবাইল বন্ধ পাচ্ছিলো। রুবি নিশ্চিত হয়েছে যে আসলামই বাচ্চাকে নিয়ে গেছে। আসলামকে খুঁজতে থাকে রুবি আর তার আত্মীয় স্বজন। কোথাও না পেয়ে শেষমেষ হালিশহর থানায় জিডি করেন রুবি।
প্রায় ৩ মাস কেটে যায়। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলোনা আফরাকে। সন্তানের শোকে দিশেহারা হয়ে যায় রুবি। অনেক খুঁজে শেষমেষ পেয়ে যায় আসলামকে। বাচ্চার জন্য আসলামকে ধরে বসে সে। এক পর্যায়ে আসলাম স্বীকার করে যে, সে বাচ্চাটিকে ৭০০০/- টাকায় রাশেদা নামের একজন মহিলার কাছে বিক্রি করে দেয়।
রুবীর মাথায় যেন বাজ পড়ে। মায়ের অপরিসীম মায়া যেন দূর্গতি নাসিনী দূর্গারূপ ধারণ করে। মায়ের অগ্নিরূপে আসলাম বাচ্চার খোঁজ দিবে বলে অঙ্গীকার করে।
আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে রুবী ছুটে যায় রাশেদার বাসায়। সাথে যায় আসলাম নিজেও। কিন্তু রাশেদাকে পায়নি তারা। পেয়েছে রাশেদার মা বাবা এবং ভাইকে। তাদের কাছেই দাবি করে সন্তানকে। আসলামও রুবির সাথে তার সন্তানকে ফেরত চায়। রাশেদার মাবাবা বলেন তারা আফরাকে দেবেনা। বাঁধে ঝগড়া। এক পর্যায়ে আসলামকে মারধর করে রাশেদার আত্মীয়রা।
আসলামকে নিয়ে রুবি যান হালিশহর থানায়। থানায় অভিযোগ করেন রুবি। থানা পুলিশ দেরি না করে ছুটে যান রাশেদার বাসায়। সেখানে পুলিশের সাথেও ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয় রাশেদার পরিবার। পুলিশ রাশেদার বাবা এবং ভাইকে ধরে থানায় নিয়ে যান। সেখানে অনেকভাবে চেষ্টা করা হয় সমঝোতার। ভালোয় ভালোয় বাচ্চাকে ফিরিয়ে দিতে বলেন পুলিশ। রাশেদার বাবা, মা, ভাইবোন সবাই মিলে তাকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু রাশেদাকে পাচ্ছিলোনা। রাশেদা বাচ্চাটিকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। বাচ্চাকে ফেরত দেয়ার জন্য পুলিশ শেষ পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয় গতকাল সকাল সাড়ে ৮ টা পর্যন্ত। কিন্তু এই সময়ে না আসায় মানব পাচার আইনে মামলা রেকর্ড করে পুলিশ। মামলা রেকর্ড করেই পুলিশ কোর্টে চালান দেয় আফরার বাবা আসলাম এবং রাশেদার বাবাকে ।
পরিবারের সবাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে শুনে রাশেদা তার স্বামীকে নিয়ে থানায় হাজির হয় মামলা দায়ের করার কয়েক ঘন্টা পরে। পুলিশ বাচ্চাটিকে তাদের হেফাজতে নিয়ে আসামীদের কোর্টে চালান করে দেয়। কিন্তু কোনভাবেই রাশেদার কোল থেকে বাচ্চাকে আলাদা করতে পারেনি কেউ। সারারাত আফরাকে কোলে নিয়ে থানায় বসে থাকে রাশেদা। বসে থাকে রুবিও।
আসলামের কাছ থেকে ১০ মাস বয়সের টুকটুকে আফরাকে পেয়ে নিঃসন্তান রাশেদা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছিলো। সন্তান আদরে পালতে থাকে আফরাকে। নিজের সন্তান হচ্ছেনা বলে আল্লাহর দরবারে দুচোখের জল ফেলেছে। অনেক ধরণের চিকিৎসা করেও কোন ফল হয়নি। একটা সন্তানের জন্য হাহাকার করতে করতে আফরাকে পেয়ে রাশেদা যেন ব্যাকুল হয়ে গেলো। আসলামের সাথে চুক্তি করে ৭০ হাজার টাকায় আফরাকে দত্তক নিয়ে নেন রাশেদা এবং সেকান্তর দম্পতি। সেই থেকে আফরাকে নিজের পেটের সন্তানের মতো লালনপালন করতে থাকেন। এর মধ্যে আফরাকে নিয়ে ভারতে নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার মাজার যিয়ারত করে আসেন। আফরার জন্য এটাসেটা, খেলনাপাতি, কাপড়চোপড় কিনেন। মাত্র ৩ মাসে রাশেদার সব আত্মীয়দের কাছে আফরা হয়ে ওঠে মধ্যমনি।
আমি রুবির পক্ষে আইনজীবী নিযুক্ত হয়ে জিম্মার জন্য চট্টগ্রামের বিজ্ঞ ৬ষ্ঠ মহানগর হাকিম এর আদালতে প্রার্থনা করি। রাশেদা তখনও শক্ত করে ধরে থাকে আফরাকে। অনবরত কাঁদতে থাকে আফরাকে জড়িয়ে ধরে। তার কান্না দেখে আমার চোখ থেকেও জল গড়িয়ে পড়ে। আমার এসোসিয়েটদের চোখও ভিজে যায়। একজন নিঃসন্তান মা কত মায়া নিয়ে ৩ টা মাস আফরাকে লালনপালন করেছে! আজকে তার বুক থেকে আফরাকে নিয়ে যাবে তার আসল মা রুবি।
আমি রুবিকে বারণ করি আফরাকে নিয়ে টানাটানি না করতে। আদালতে যতক্ষণ থাকবে আফরা তার পালক মা রাশেদার কোলে থাকবে।
মহানগর হাকিম আদালতের বিজ্ঞ বিচারক জনাব মেহনাজ রহমান বৈচারিক প্রজ্ঞার প্রচলনে প্রদত্ত আদেশে আফরাকে তার গর্ভধারিণী মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেন। আফরাকে তার মা রুবির হাতে তুলে দেয়ার কথা বলে আদালতের জিআরও ইউসুফ ভাইকে বিশেষ অনুরোধ করে আমি চেম্বারে চলে আসি।
ভাবছি রাশেদা যখন আফরাকে রুবির কোলে ফিরিয়ে দিচ্ছিলো তার কাছে কেমন লেগেছিলো!
শুনেছি রাশেদা সারাক্ষণ কাঁদলেও আফরাকে রুবির কোলে তুলে দেয়ার সময় একটু করে হেসেছিলো।
আফরা তখন ঘুমুচ্ছিলো। কারণ ঘুমুবার আগে সে রাশেদার কোল ছেড়ে কারো কোলে যায়নি। এমনকি তাকে জন্ম দেয়া মায়ের কোলেও নয়।
প্রসঙ্গত, সন্তান হচ্ছে মায়েদের সবথেকে মুল্যবান জিনিস, প্রতিটি সন্তান মায়েদের অমুল্য ধন। তবে যারা মাতৃত্বের সাধ পাননি তারা আসলেই বঞ্চিত, অনেকে আছেন সন্তান জন্ম না দিয়েও মাতৃত্বের সাধ পান অন্যের সন্তান লালন পালন করে এবং তাদের মানুষের মত মানুষ করার মাধ্যমে।