নবম শ্রেণীতে পড়া অবস্হায় হার্ট অ্যাটাকে পিতার মৃত্যু হয়৷ তিন ভাই-বোনের মধ্যে একজন আবার শারীরিক প্রতিবন্ধী। ‘কড়া’ নামক এই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারটি যেসময়ে তিন বেলা শুধুমাত্র ভাত খাওয়ার নিশ্চয়তাটুকুও পাচ্ছিলো না সেসময় শিক্ষা অর্জন বা পড়াশোনা তো বিলাসিতারই নামান্তর হওয়ার কথা। কিন্তু সব রকমের প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে, কষ্ট সামলে দিনাজপুরের বিরল উপজেলার এই তরুণ অবশেষে ভর্তি হয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে। কড়া নৃগোষ্ঠীর প্রথম সন্তান হিসেবেই এই অর্জন করলেন তিনি। এর আগে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স বিভাগেও ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি।
জনসংখ্যা মোট ১০৪ জন। লাপোলের আগে তাদের কেউ মাধ্যমিকের গণ্ডিও পেরোতে পারেনি। তার আগে কড়াদের সর্বোচ্চ পড়াশোনা জানা ব্যক্তি ছিলেন কৃষ্ণ কড়া। তিনি দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আসতে বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে লাপোলকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া লাপোলকে প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে বৃত্তি দিচ্ছে পে ইট ফরোয়ার্ড বাংলাদেশ। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা পর্যন্ত এই বৃত্তি পাবেন লাপোল। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীও বাসায় ডেকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তাঁকে। তিনি ২৫ হাজার টাকাও দিয়েছিলেন। সেই টাকায় কড়া, ওঁরাও, সাঁওতাল ও পাহানদের মোট ৫০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে খাতা, কলম, ডায়েরিসহ নানা শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করেছেন লাপোল। একটা সাইকেল কিনে দিয়েছেন পাহান সম্প্রদায়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী রিতিক পাহানকে।
লাপোল বলছিলেন, ‘আমি অন্ন, বস্ত্রের কষ্ট, সমাজের হাজারো প্রতিবন্ধকতার নদী পাড়ি দিয়ে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এসে পৌঁছেছি। আমার মতো অনেকেই আছে গ্রামে। প্রত্যেককে একটা করে সাইকেল দিতে পারলে ভালো লাগতো। আমার তো সামর্থ্য নেই। তাই একটা দিয়ে শুরু করলাম। ইচ্ছে ছিল আমাদের গ্রামসহ, ওঁরাও এবং সাঁওতাল এই দুই গ্রামের অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ফরম ফিলাপের ফি দিব। কিন্তু পারিনি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও নিজের লড়াই এখনো শেষ হয়নি বলে জানিয়েছেন লাপোল। পাড়ার অন্য সব শিক্ষার্থীকেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াতে চান তিনি। এ প্রসঙ্গে লাপোল বলেন, “জন্ম নিয়ে জীবন পেয়েছি। বয়সের সঙ্গে ক্ষুধা বেড়েছে। ক্ষুধা ‘খেয়ে’ ক্ষুধা নিবারণ করে বড় হয়েছি। অনেক কষ্টের ফল পত্রিকার পাতায় ‘তারা’ হয়েছি। সত্যিকারের ‘তারা’ যেন হতে পারি। কোটি মানুষের না হোক, নিজের মানুষদের, কড়া, ওঁরাও, মুণ্ডা, মুশহরসহ আমাদের পিছিয়ে পড়া শিশুদের জীবন আলোকিত করায় ভূমিকা রাখতে পারি। এ প্রার্থনা সেসব মানুষের কাছে, যাঁদের ভালোবাসা পেয়ে আমি বুঝতে পেরেছি ‘সূর্য রাতের অন্ধকার দূর করে’। ”
ইতোমধ্যে ছোট বোন পূর্ণিমাকেও দিনাজপুর থেকে ঢাকায় নিয়ে এসেছেন লাপোল। ভর্তি করেছেন মিরপুরের বনফুল গ্রিনহার্ট আদিবাসী স্কুল অ্যান্ড কলেজে, নবম শ্রেণিতে। পূর্ণিমার পড়াশোনার খরচ বহন করছেন এশিয়াটিক ইভেন্টস মার্কেটিং লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক (প্রশাসন) ফারুক আহমেদ।
লাপোলের মা সাতোল কড়া বলেছেন, ‘আমি কোনো দিন স্কুলে যাই নাই। বিশ্ববিদ্যালয় কী জিনিস তাও জানি না। অনেক কষ্টে ছেলেটাকে পড়াইছি। সবাই এখন লাপোলের কথা বলছে। আমার খুব ভালো লাগছে। ’
সবরকমের সুযোগ-সুবিধা আর বিলাসী জীবনযাপন করেও রাজধানীর অভিজাত পরিবারের সন্তানরা যখন মাদকগ্রহণ, অনৈতিক কর্মকান্ড সহ নানাবিধ উপায়ে বিপথে চলে যাচ্ছে সেখানে এইরকম গল্প হতে পারে সবার জন্য অনুপ্রেরণাময়।