সাম্প্রতি ৩ কেন্দ্রীয় নেতার রাজশাহী সফর নিয়ে শুরু হয়েছে নানা ধরনের সমালোচনা। জানা গেছে, নিজেদের ক্ষমতা খাটিয়ে রাজশাহীর এক হোটেলে উঠে নানা ধরনের অপকর্ম করেন তারা। এরইমধ্যে তাদের এই অপকর্মের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন বাংলাদেশের একটি জাতীয় সংবাদমাধ্যম। যেই প্রতিবেদনে তাদের রাজশাহী সফর শুরু এবং ফেরার সম্পূর্ণ বিষয় সম্পর্কে উপস্থাপন করা হয়।
জানা গেছে রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সাকিবুল ইসলাম রানা ও সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন অমির বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগের তদন্ত করতে রাজশাহীতে এসেছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের এই তিন নেতা। তারা ঢাকা থেকে বিমানে এসে আবার বিমানে ফিরে যান। কিন্তু এর মধ্যে তাদের একদিনের ঝাটকা সফর ও তৎপরতা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এ নিয়ে ছাত্রলীগের সাধারণ নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। তারা বলছেন, তদন্তের নামে কেন্দ্রীয় নেতারা নাটক-ফুর্তি করেছেন।
জানা গেছে, তদন্ত কমিটির সদস্যরা রাজশাহীর পর্যটন মোটেলের ভিআইপি স্যুটে এক রাত অবস্থান করেন। তিনজনের এক রাত থাকার বিল ১৮ হাজার টাকা। খাবারের বিল এসেছে ১৬ হাজার ৯৭২ টাকা। কিন্তু তারা নিজেরা এই বিল পরিশোধ করেননি। দেরি না করে এয়ারপোর্টে চলে যান। সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসাবাদের পর বিল পরিশোধ করা হয়। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে নভো এয়ারের একটি বিমানে তারা রাজশাহী ত্যাগ করেন।
কমিটি গঠনের সাত মাসের মধ্যেই প্রকাশ্যে আসে রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নানা অপকর্ম। একই সময়ে এ নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সম্প্রতি রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সাকিবুল ইসলাম রানার একটি অডিও ভাইরাল হয়। নিজেকে ‘প্রতারক চক্রের নেতা’ উল্লেখ করে রানা এক নারী কর্মীকে যৌ/ ন হয়রানি করেন এবং তাকে অন্য মেয়ে পাঠাতে বলেন। অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন আমিরের ফে/ নসিডিল সেবনের ভিডিও ভাইরাল হয়। গণমাধ্যম ছাড়াও ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
অভিযোগ তদন্তে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক উকার ভট্টাচার্য তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেন। তদন্ত কমিটির সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটির জনসংযোগ ও উন্নয়ন সম্পাদক শেখ শামীম তূর্য, উপ-আইন সম্পাদক আপন দাস ও সহ-সম্পাদক তানভীর আবদুল্লাহ ইউএস বাংলার একটি ফ্লাইটে সোমবার সকালে রাজশাহী আসেন। এরপর তারা রাজশাহী পর্যটন মোটেলের তিনটি ভিআইপি স্যুটে যান। প্রতিটি কক্ষের ভাড়া ৬ হাজার টাকা থেকে ১৮ হাজার টাকা। তাদের খাবারের বিল আসে ১৬ হাজার ৯৭২ টাকা।
মঙ্গলবার বিকেলে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় নেতারা ৪টা ১০ মিনিটে পর্যটন মোটেল থেকে বেরিয়ে সাদা প্রাইভেটকারে ওঠেন। কিন্তু তারা মোটেলের বিল পরিশোধ করেননি। কেন্দ্রীয় নেতারা বের হওয়ার সময় জেলা ছাত্রলীগের কথিত সভাপতি-সম্পাদকও উপস্থিত ছিলেন। সবাই চলে যাওয়ার পর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের কর্মী মাসুক হেলাল পর্যটন মোটেল কাউন্টারে গিয়ে জানতে পারেন বিল কত।
এ সময় মাসুক হেলাল জানান, জেলা ছাত্রলীগের সেক্রেটারি জাকির হোসেন আমিও রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ছাত্র। তিনিও এই মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করেছেন। তিনি বিলটি জেনেছেন- জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বিল পরিশোধ করবেন। মাসুক বলেন, সোমবার কেন্দ্রীয় নেতারা আসার আগেই হেলাল রুম বুক করে রেখেছিলেন।
পর্যটন মোটেলের রিসেপশনিস্ট আব্দুল জলিল বলেন, ‘তারা পর্যটন মোটেলের ভিআইপি স্যুটে থেকেছেন। ১৮ হাজার টাকার বিল এসেছে। আপনি 20 শতাংশ ছাড় পাবেন। খেয়েছে ১৬ হাজার ৯৭২ টাকা। তারা বিল না দিয়েই চলে যায়। তাদের রুম বুক করেছিলেন মাসুক হেলাল নামে রাজশাহীর এক মেডিকেল ছাত্র। তিনি বলেন, বিমানবন্দরে তাদের নামিয়ে বিল পরিশোধ করবেন।
বিমানে ওঠার আগে তানভীর আবদুল্লাহকে জিজ্ঞেস করলে তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘বিলটা দেননি? আমি এগুলো জানি না। আমাদের স্থানীয় সভাপতি-সেক্রেটারি বলেন, আমরা বিলটি তৈরি করছি। কত বিল আসছে?’ অভিযুক্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কেন বিল দেবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনারা হয়তো জানেন না, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ যেখানেই যায়, স্থানীয় লোকজন খরচ করে। সব জায়গায় তারা করে। যদি তারা না করে, আমরা করব। এখন আমি জানি, আমরা পকেট থেকে পরিশোধ করব। এটা কোন ব্যাপার না।’
কোন বিমানে ঢাকা যাচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোন বিমানে যাচ্ছেন তা এখনো দেখিনি। তারা টিকিট কিনছে।’ কারা টিকিট কিনছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরাই করছি।’ রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের ফ্লাইটের টিকিট কিনেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের বাপ-চাচা বা পরিবারের কোনো ঐতিহ্য নেই? আমরা তিন-চার হাজার টাকার ফ্লাইটের টিকিট দিতে পারছি না। তারা কেন দেবে?’ পরে সন্ধ্যা ৬টায় তানভীর আবদুল্লাহ বলেন, আমরা বিল পরিশোধ করেছি। সেই সময় তিনি হোয়াটসঅ্যাপে বিল পরিশোধের ভাউচারও পাঠিয়েছিলেন।
এরপর পর্যটন মোটেলের রিসেপশনিস্ট আব্দুল জলিল ফোনে জানান, এক ব্যক্তি এসে তিন রুমের জন্য ২০ শতাংশ ছাড়ে ১৪ হাজার ৪০০ টাকা এবং খাবারের জন্য ১৬ হাজার ৯৭২ টাকা দেন। তবে পরিচয় জানাতে পারেননি তিনি।
জানতে চাইলে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন অমি বলেন, ‘তারা আমাদের অতিথি। আমরা এখনো ছাত্রলীগের কমিটিতে আছি। আমরা দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি. আমাদের কমিটির কার্যক্রম স্থগিত নয়। কেন্দ্রের নেতারা এলে আবাসন ও খাবারের ব্যবস্থা করি। তাই আমরা বিল দিতে চেয়েছিলাম। পরে তারা বলেন, বিল দিলে কথা হবে।
সেই রাতের পর থেকে, তিনি একটি পর্যটন মোটেলে বসে তদন্ত করেন।
ছাত্রলীগের একাধিক নেতা বলেন, ‘এসব তদন্ত স্রেফ নাটক। লোক দেখানো।’ যাদের টাকা নিয়ে অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে কী তদন্ত হবে?’
তদন্তে কী পাওয়া গেছে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির সদস্য ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-আইন বিষয়ক সম্পাদক আপন দাস বলেন, ‘আমরা যা পেয়েছি তা কাউকে বলার সুযোগ নেই। তদন্ত প্রতিবেদন অফিস সেলে জমা দেব। এরপর সভাপতি-সম্পাদক তা প্রকাশ করবেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে। আমরা তদন্ত করেছি। অনেকের সাথে কথা বলেছি। তদন্তে কী পাওয়া গেছে, পরে জানানো হবে।
১৫ সেপ্টেম্বর এই নেতাদের তদন্ত করতে রাজশাহীতে পাঠানো হয়। আজ ২১ তারিখ এখনো পর্যন্ত তারা তাদের তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে পারেনি। তবে দলটির নেতারা সাফ জানিয়ে দিয়েছে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে যেভাবেই হোক তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।