বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অভিযুক্ত পিকে হালদার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও তাঁর সাথে সম্পর্কযুক্ত ও তাঁর সিন্ডিকেটের অনেককেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সঠিক সময়ে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয়েছিলো৷ আর গ্রেপ্তারকৃতদের জবানবন্দির মাধ্যমে প্রতিনিয়ত উঠে আসছে অর্থলোভী এই পিকে হালদারের( PK Haldar ) টাকা লুট করার অভিনব সব পদ্ধতির৷
প্রশান্ত কুমার( Kumar ) (পিকে) হালদারসহ( Haldar ) ছয় জনের নেতৃত্বে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফাস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড( Fas Finance Investment Limited ) লুট করা হয়েছে। শুধু ১৪টি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়েই ৬১৬ কোটি টাকা লোপাট করেছে ওই সিন্ডিকেট। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের( NRB Global Bank ) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন পিকে।
বুধবার আদালতে ফাস ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাসেল শাহরিয়ারের( Russell Shahriar ) স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে এসেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক( ACC )) করা এক মামলায় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় তিনি এ জবানবন্দি দেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জসীম উদ্দিন( Jasim Uddin ) আসামির স্বীকারোক্তি রেকর্ড করেন। রেকর্ড শেষে আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেওয়া হয়।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে রাসেল শাহরিয়ার বলেন, আমি ১৯৮৯ সালে খিলগাঁও হাই স্কুল( Khilgaon High School ) থেকে এসএসসি ও ১৯৯১ সালে তেজগাঁও কলেজ( Tejgaon College ) থেকে এইচএসসি পাশ করি। ১৯৯৪ সালে বুয়েটে( BUET ) ভর্তি হই। ১৯৯৮ সালে বুয়েট থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং( Mechanical engineering ) পাশ করি। ১৯৯৯ সালে বেসিক ব্যাংকে( Basic Bank ) যোগদান করি। ২০০৫ সালে ইউনাইটেড লিজিংয়ে( United Leasing ) যোগদান করি। এরপর ২০০৬ সালে আইআইডিএফসিতে( IIDFC ) যোগদান করি। ওই সময় আমার অপারেশন হেড ছিলেন পিকে হালদার। ২০০৮ সালে পিকে হালদার রিলায়েন্স লিজিংয়ে( Reliance Leasing ) এমডি হিসাবে যোগদান করেন। আমি ২০১৪ সালে আইআইডিএফসিতে( IIDFC ) ইভিপি হই এবং ২০১৪ সালের( year ) জুন মাসে মাইডাস ফাইন্যান্সের( Midas Finance ) এমডি হিসাবে যোগদান করি। উজ্জল কুমার( Kumar ) নন্দী( Ujjal Kumar Nandi ) ছিলেন পিকে হালদারের( PK Haldar ) বিশ্বস্ত সহযোগী। তিনি ২০০৮ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত আইআইডিএফসিতে( IIDFC ) সিএফও ছিলেন। পরে গোল্ডেন লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে( Golden Life Insurance Company ) এবং ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত রিলায়েন্স ফাইন্যান্সে পিকে হালদারের( PK Haldar ) উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেন। আমি মাসিক ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা বেতনে এফএএস ফাইন্যান্সের এমডি হিসাবে ২০১৪ সালের( year ) নভেম্বর মাসে যোগদান করি।
রাসেল আদেশ পেতেন যেভাবে : স্বীকারোক্তিতে রাসেল শাহরিয়ার বলেন, এফএএস ফাইন্যান্সে যোগদানের সময় চেয়ারম্যান ছিলেন এ হাফিজ। পরিচালক ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম( Jahangir Alam ), উজ্জল কুমার( Kumar ) নন্দী( Ujjal Kumar Nandi ) ও সিদ্দিকুর রহমান।( Siddiqur Rahman. ) এই তিনজনই এফএএস ফাইন্যান্সের বোর্ডে খুব প্রভাব বিস্তার করত। উজ্জল কুমার( Kumar ) নন্দী( Ujjal Kumar Nandi ) ছিলেন পিকে হালদারের( PK Haldar ) ডানহাত। পিকের( Picker ) অপর সহযোগী নাহিদা রুনাই( Nahida Runai ) প্রায়ই আমাকে ফোন করে বলতেন-‘ফাইলটি পাঠিয়ে দিচ্ছি। এটা পিকে হালদারের( PK Haldar ) ফাইল। তাড়াতাড়ি বোর্ডে পাঠিয়ে দেন। এগুলো নিয়ে আপনার চিন্তার কিছু নেই। এগুলো বোর্ডের দায়িত্ব। আপনি নির্ভয়ে কাজ করেন।’ ক্রেডিট হেড হিসাবে প্রাণ গোরাঙ্গ দে( Gorang de ) যোগদান করার পর তারাই যোগাযোগ করে সরাসরি পিকে হালদারের( PK Haldar ) কাছ থেকে ফাইল নিয়ে আসত। পিকে হালদারের( PK Haldar ) নির্দেশমতো বোর্ডে ফাইল উপস্থাপনের জন্য নোট তৈরি করে তাকে স্বাক্ষর করত এবং আমাকে বোর্ডে উপস্থাপনের জন্য বলত। পিকে হালদার মাঝেমধ্যে এফএএস ফাইন্যান্সের বোর্ড মিটিংয়ে( board meeting FAS Finance ) উপস্থিত থাকতেন। পিকে হালদার আমার চেম্বারেও তিনবার এসেছিলেন। বোর্ডে ফাইল গেলে বলা হতো এটি পিকে হালদারের( PK Haldar ) ফাইল। আর পিকে হালদারের( PK Haldar ) ফাইল বলার সঙ্গে সঙ্গেই সবাই এক বাক্যে কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই ছাড়াই তা অনুমোদন করে দিত।
যেভাবে ৬১৬ কোটি টাকা লোপাট : রাসেল আদালতকে আরও বলেন, আরিয়ান কেমিক্যাল লিমিটেড, মীম ট্রেডিং করপোরেশন, কণিকা এন্টারপ্রাইজ, মুন এন্টারপ্রাইজ, এন্ডবি ট্রেডিং, আরবি এন্টারপ্রাইজ, জিএন্ডজি এন্টারপ্রাইজ, বর্ণ, উইনটেল করপোরেশন লিমিটেড, সন্দীপ করপোরেশন, সুখদা প্রপার্টিজ লিমিটেড, হাল ইন্টারন্যাশনাল, আনান কেমিক্যাল লিমিটেড, নিউট্রিক্যাল লিমিটেড, নিউটেক এন্টারপ্রাইজ, ন্যাচার এন্টারপ্রাইজ, এসএ এন্টারপ্রাইজ-এই ১৭টি প্রতিষ্ঠানই পিকে হালদারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের বিপরীতে বন্ধকী সম্পত্তির মালিকানা হলো পিকে হালদারের আত্মীয় ও সহযোগীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এমএসটি ফার্মা এন্ড হেলথ কেয়ার লিমিটেড, এমার এন্টারপ্রাইজ, মেরনি এন্টারপ্রাইজ, এমটিবি মেরিন লিমিটেড হলো নওশেরুল আলম ও বাসুদেব ব্যানার্জীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। যারা পিকে হালদারের ব্যবসায়িক পার্টনার। জেডএ ট্রেডিং হাউজ, দ্রিনান অ্যাপারেলস লিমিটেড হলো জাহাঙ্গীর আলমের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। নওশের, বাসুদেব, জাহাঙ্গীর, সিদ্দিকুর রহমান, উজ্জল কুমার নন্দী ছিলেন পিকে হালদারের বিশ্বস্ত সহযোগী। এই সিন্ডিকেটই মূলত এফএএস ফাইন্যান্স লুট করেছে। আমি তাদের চাপেই মূলত কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়া, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মর্টগেজ ছাড়া অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে একক স্বাক্ষরে কিছু ফাইল বোর্ডে উপস্থাপন করি। বোর্ডের অনুমোদনের পর সেগুলো পিকে হালদার ও উজ্জল নন্দীর কথামতো অনুমোদিত ঋণ হিসাবের টাকা বিতরণ না করে তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট হিসাবে ঋণের টাকা স্থানান্তরের অনুমোদন দিই। যার ফলে ঋণের টাকা পিকে হালদারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট হিসাবে স্থানান্তর হয়েছে।
স্বীকারোক্তিতে বলা হয়, আরিয়ান কেমিক্যাল লিমিটেড, মীম ট্রেডিং, কণিকা এন্টারপ্রাইজ, মেরিনট্রাস্ট, মুন এন্টারপ্রাইজ, এমার এন্টারপ্রাইজ, আরবি এন্টারপ্রাইজ, জিএন্ডজি এন্টারপ্রাইজ, বর্ণ, সুখদা প্রপার্টিজ লিমিটেড, আনান কেমিক্যাল লিমিটেড, দিয়া শিপিংয়ের নামে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের চেক ব্যবহার করা হয়েছে। নিউটেক এন্টারপ্রাইজ, ন্যাচার এন্টারপ্রাইজ, দিয়া শিপিং, এমটিবি মেরিন লিমিটেড, এমার এন্টারপ্রাইজ, জিএন্ডজি এন্টারপ্রাইজ, মেরিন ট্রাস্ট লিমিটেড, এমএসটি ফার্মা এন্ড হেলথ কেয়ার লিমিটেড-এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ঠিকানা একই।
এগুলোর সবই অস্তিত্বহীন। এই আটটি প্রতিষ্ঠানের নামে ৩৩১ দশমিক ১৯ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়।
আবার বর্ণ, আরবি এন্টারপ্রাইজ, এসএ এন্টারপ্রাইজ, উইন্টেল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, হাল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড ও সন্দীপ করপোরেশন-এই ছয়টি প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা একই। এসব অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপরীতে ২৮৫ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। মূলত পিকে হালদারের নির্দেশে এসব অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পিকে হালদারের বিরুদ্ধে চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। পিকে সিন্ডিকেটের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় দুদক অদ্যাবধি ২২টি মামলা করেছে। এছাড়া সম্প্রতি ফাস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড থেকে ৫২৩ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ১৩টি মামলার অনুমোদন দেওয়া হয়।
অনুমোদিত ১৩টি মামলার সব সম্পন্ন হলে মামলা হবে ৩৫টি। মামলাগুলোতে ২ হাজার কোটি টাকার ওপর আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। অদ্যাবধি এসব মামলায় ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এসব মামলায় আদালত ৬৯ জনকে দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। এছাড়া ২০২১ সালের অক্টোবরে পিকে হালদারের বিরুদ্ধে করা অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় আদালতে চার্জশিটও (অভিযোগপত্র) দেওয়া হয়েছে।
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যেকোনো মানুষের অর্থ প্রয়োজন। কিন্তু আর্থিক মোহে অন্ধ হয়ে সাধারণ মানুষের কষ্টে সঞ্চিত টাকা লুট করে দেওয়ার মানসিকতা যার বা যাদের থাকে তাদের আর যাই হোক, ‘মানুষ’ বলা যায়না৷ অচিরেই পিকে হালদারকে দেশে ফেরত এনে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণস্বরূপ দ্রুততার সাথে শাস্তি কার্যকর করা হবে, এমন প্রত্যাশার অপেক্ষায় সবাই৷