সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিরোধী দলগুলোর চলমান একদলীয় আন্দোলনে একযোগে মাঠে নামছে জামায়াতে ইসলামী। এ বিষয়ে বিএনপির হাইকমান্ডের সঙ্গে দলের নীতিনির্ধারকদের একাধিক বৈঠক হয়েছে। সম্প্রতি দুই পক্ষের মধ্যে দূরত্ব কমানোর চেষ্টা চলছে। বৈঠকের মাধ্যমে একসঙ্গে আন্দোলন কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন উভয় দলের বর্তমান নেতারা। তবে যুগপতের সঙ্গে যুক্ত কয়েকটি দল জামায়াতের সঙ্গে আন্দোলনের বিরোধিতা করছে।
এদিকে বিএনপি চায় সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক দল ও জোট একদলীয় আন্দোলনের চূড়ান্ত ফসল ঘরে তুলতে। নির্বাচনের আগে প্রায় সব সরকারবিরোধী দল ও জোটকে একই প্লাটফর্মে এনে আন্দোলনে জড়ো করার কাজ চলছে।
বিএনপি ও জামায়াতের বর্তমান নেতারা বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন করাই তাদের মূল লক্ষ্য। এ দাবিতে একপক্ষের চলমান আন্দোলনের ফলে রাজধানীতে বিএনপি-জামায়াতের ১৫টি আঞ্চলিক সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর উত্তরে ৯টি ও দক্ষিণে ৬টি। প্রতিটি কমিটিতে বিএনপি থেকে একজন ও জামায়াত থেকে একজনকে টিম লিডার এবং একজন করে সমন্বয়ক নিয়োগ করা হয়েছে। দু-একদিনের মধ্যে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হবে বলে সরকারি সূত্রে জানা গেছে।
জামায়াতের একজন কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির কালবেলাকে বলেন, যে কোনো দিন একই মঞ্চে আসার ঘোষণা আসবে। এরই মধ্যে বিএনপির সঙ্গে ঢাকা মহানগরসহ সারাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কয়েক দফা মতবিনিময় হয়েছে। আন্দোলন সমন্বয় করতে সারাদেশে বিএনপি-জামায়াতের একাধিক টিমও গঠন করা হয়েছে। তবে, এ বিষয়ে বিএনপির কোনো দায়িত্বশীল নেতা প্রকাশ্যে কিছু বলতে চাননি।
বর্তমানে যুগপৎ আন্দোলনে সরাসরি না থাকা জামায়াত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে বিএনপির সঙ্গে মিল রেখে একই কর্মসূচি পৃথকভাবে দলীয় ব্যানারে পালন করছে। যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে আগামীকাল সোমবার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। তাদের মতো একই কর্মসূচি দিয়েছে জামায়াতও। পর্যবেক্ষকদের দাবি, বিএনপি-জামায়াত সম্পর্ক নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রচারণায় পশ্চিমা বিশ্বের এক ধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। এ ক্ষেত্রে কৌশলগত কারণে জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখছিল বিএনপির হাইকমান্ড। এখন নতুনভাবে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির কোনো বোঝাপড়া হলে চলমান আন্দোলনকে ভন্ডুল করতে কোনো একটি পক্ষ সুযোগ নিতে পারে।
সরকারের পদত্যাগ চেয়ে ২০২২ সালের ২৪ ডিসেম্বর থেকে প্রথমে ১০ দফা, পরবর্তী সময়ে একদফা দাবিতে যুগপৎভাবে আন্দোলন চালিয়ে আসছে বিএনপি। এ আন্দোলনে বিএনপিসহ ৩৯টি রাজনৈতিক দল যুক্ত রয়েছে। বিএনপির দপ্তর সূত্রের দাবি, ৩৯টি দল যুগপৎ আন্দোলনে থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বয়কট করেছে ৬৪টি রাজনৈতিক দল। দেশের জনগণ ও ভোটারদের ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি।
১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়তে গিয়ে বিএনপি জামায়াতকে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠন করে, যা পরে ২০-দলীয় জোটে রূপান্তর হয়। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধিতাকারীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দেওয়ায় তখন ব্যাপক সমালোচনা হয়। রাজাকার, আলবদরদের পুনর্বাসনের অভিযোগ এখনো বিএনপির বিরুদ্ধে তোলা হয়। তা সত্ত্বেও ২০০৬ সালে চারদলীয় জোট সরকারের মেয়াদ শেষ হলেও জোট অটুট ছিল। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ মহাজোট সরকার গঠন করলে বিএনপি-জামায়াত ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করছিল। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠেকাতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, তাতেও জামায়াতের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।
এক পর্যায়ে, কৌশলগত কারণে ৯ ডিসেম্বর, ২০২২-এ ২০-দলীয় জোট বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিছুদিন পর ‘১২ দলীয় জোট’ এবং আরও ১১টি দল ‘জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট’ গঠন করে। জামায়াত কোনো জোটে না গেলেও বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় ছিল। ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া যুগপৎ আন্দোলনেও জামায়াত আলাদাভাবে একই কর্মসূচি পালন করে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, যা বিচ্ছেদের দিকে নিয়ে গেছে। ২০২২ সালের ২৪ ডিসেম্বর থেকে বিএনপি, জামায়াতের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোর একযোগে আন্দোলন কর্মসূচি প্রাথমিক দুটি কর্মসূচিতে অংশ নেয়। এরপর আর কোনো কর্মসূচিতে অংশ না নিয়ে একই কর্মসূচি পালন করে আসছে দলটি। জানা গেছে, বিএনপি নেতৃত্বের প্রতি ক্ষোভ ও অবজ্ঞা থেকেই জামায়াতের ‘একলা চলো’ নীতি শুরু হয়। সে সময় বিএনপি অন্য সব দলের সঙ্গে একযোগে সরকারবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করলেও জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। এরপরও বিএনপির সঙ্গে একযোগে আন্দোলনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে গত বছরের ২৪ ও ৩০ ডিসেম্বর গণমিছিলে অংশ নেয় জামায়াত। এর আগে ১২ ডিসেম্বর রাতে গ্রেফতার হন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান। গত ৩০ ডিসেম্বর মালিবাগে একযোগে জনসভা করতে গিয়ে জামায়াতের শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার ও আহত করা হয়। এ বিষয়ে বিএনপি কোনো বক্তব্য বা বিবৃতি দেয়নি। যুগপতের পরবর্তী কর্মসূচি নিয়েও জামায়াতের সঙ্গে আলোচনা করেননি তারা। এরপরই জামায়াত আন্দোলন থেকে সরে আসে।
জামায়াতের কয়েকজন নীতিনির্ধারক আলাপকালে বলেন, বর্তমান সরকারের ওপর জনগণ ক্ষুব্ধ বলে অনেকেই মনে করছেন। কারণ এই চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনে জামায়াতকে ছাড়াই বিএনপি সফল হতে পারে। এ কারণে যুগপৎ আন্দোলনে জামায়াতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মতে, সরকারের হিংসাত্মক কার্যক্রম, সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে কোনো বিরোধী দল রাস্তায় না নেমে চুপ থাকতে পারবে না। এদিকে রাজপথে সক্রিয় সব বিরোধী দল। এ অবস্থায় জামায়াতেরও মাঠে সরকারবিরোধী কঠোর অবস্থান নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
আগামীকাল সকাল-সন্ধ্যা হরতাল: সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসা, সেক্রেটারিসহ বিএনপির নেতাকর্মীদের মুক্তি। জেনারেল মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও একতরফা দাবি আদায়ে আগামীকাল সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। শনিবার এক ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এ ঘোষণা দেন।