বৃষ্টি খাতুন না অভিশ্রুতি শাস্ত্রী- এই দুই নামের বিভ্রান্তির কারণে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের মর্গে লাশ পড়ে আছে। হস্তান্তর নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। পরিবারের অজান্তেই ধর্ম পরিবর্তন করে মেয়েটি। তাই লাশ নিতে এসে তার বাবা বিপাকে পড়েন। শনিবার সকাল পর্যন্ত তার লাশ হস্তান্তর করা হয়নি।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের মধ্যে একজন নারী সাংবাদিকও রয়েছেন। প্রাথমিকভাবে সহকর্মীরা অভিশ্রুতি শাস্ত্রী হিসেবে চিহ্নিত। তিনি অনলাইন নিউজ পোর্টাল TheReport.live-এ কাজ করতেন।
জানা যায়, তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার বেতবাড়িয়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বনগ্রাম। তার পিতার নাম শাবলুল আলম সবুজ।
সার্টিফিকেট, জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্রে তার নাম বর্ষী খাতুন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নিহতের পরিবার, স্বজন ও বেতবাড়িয়া ইউনিয়নের ইউপি সদস্য আব্দুল মজিদ।
তার বাবা শাবলুল আলম সবুজ ইসলাম ধর্মের অনুসারী এবং তার মাতা বিউটি বেগমও ইসলাম ধর্মের অনুসারী। যাইহোক, অভিশ্রুতির বায়োডাটা দেখায় যে তিনি একজন ঐতিহ্যবাদী।
বৃষ্টির মা বিউটি বেগম ও তার খালা সাবানা খাতুন বলেন, বৃষ্টি কবে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেছে জানি না। সে মুসলিম পরিবারের মেয়ে। সার্টিফিকেট, জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয় পত্রে তার নাম বৃষ্টি খাতুন। তার লাশ আমরা গ্রামের বাড়িতে দাফন করব। বৃষ্টি যতই ভুল করুক না কেন, আমাদের সন্তান আমরা দাফন করব।
বৃষ্টির চাচাতো ভাই তামিম জানিয়েছেন, বৃষ্টি ধর্মান্তরিত হয়েছে। এরপর স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টির সত্যতা জানা যায়।
৭নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুল মজিদ জানান, অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর আসল নাম বৃষ্টি। তিনি মুসলিম। বার্শি ইডেন কলেজে পড়ে। সার্টিফিকেট, জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্রে তার নাম বৃষ্টি।
নিহত সাংবাদিক শাবলুল আলম সবুজের বাবা রাজধানী ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। দরিদ্র বাবার তিন মেয়ে। বৃষ্টি খাতুন সবার বড়। মেজো মেয়ে শারমিনা সুলতানা ঝর্ণা রাজবাড়ী সরকারি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ছোট মেয়ে বর্ষা দশম শ্রেণিতে পড়ছে।
বৃষ্টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে পড়েছেন গ্রামের বিদ্যালয়ে। উচ্চ মাধ্যমিক পড়েছেন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে। বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঢাকার ইডেন কলেজে দর্শন শাস্ত্র নিয়ে পড়েছেন। উচ্চশিক্ষা শেষ করার আগে বিসিএস কোচিং নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।
নিহতের ছোট বোন শারমিনা সুলতানা ঝর্ণা জানান, বৃহস্পতিবার দুপুরে মায়ের সঙ্গে মোবাইল ফোনে বৃষ্টির শেষ কথা হয়। বৃষ্টি সাংবাদিকতা করলেও মা বাড়ি থেকে টাকা পাঠাতেন। বড় বোনের মৃত্যুতে তাদের সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। দুই মাস আগে অভিশ্রুতি শেষবার গ্রামের বাড়িতে এসেছিল।
তার বোন হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে কি না জানতে চাইলে ঝর্ণা বলেন, এটা হতে পারে না। আমার বোন মনে-প্রাণে একজন মুসলিম। তিনি কখনো তার ধর্ম ত্যাগ করেননি। তবে, ঝর্ণা স্বীকার করেছেন যে সম্প্রতি তার বোন অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর নামে একটি ফেসবুক আইডি খুলেছিলেন এবং সেই নামটি ব্যবহার করে সাংবাদিকতা করছিলেন।
বেতবাড়িয়া ইউপির চেয়ারম্যান ও বনগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম জানান,
ওই বিদ্যালয় থেকে ২০১৫ সালে মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি করে বৃষ্টি। স্বাধীনচেতা ছিল। ছোট বেলা থেকে সে সরকারি বড় চাকরির স্বপ্ন দেখত।
বৃষ্টির ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টি তিনিও অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, মাস দুয়েক আগে ওর সঙ্গে রাজধানীর ফার্মগেটে দেখা ও কথা হয়। তার দাবি ধর্মান্তরের যে কথাটি বলা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
জানা যায়, মুসলিম পরিবারে বেড়ে ওঠা সত্ত্বেও অভিশ্রুতি ওরফে বৃষ্টি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মতো আচরণ করতেন, তিনি নিজেই নিজের নাম পরিবর্তন করে ‘অভিশ্রুতি’ রাখেন। সহকর্মীরাও তাকে অভিশ্রুতি নামেই চিনতেন। তিনি হিন্দিতে কথা বলতে পারতেন।তার যাতায়াত ছিল রমনা কালী মন্দিরেও। তবে পারিবারিক পরিচয় গোপন করতেন। কর্মক্ষেত্রে জমা দেওয়া বায়োডাটায়ও নিজেকে সনাতন ধর্মাবলম্বী হিসেবে উল্লেখ করেছেন এই তরুণী।
রমনা কালী মন্দির কমিটির সভাপতি উৎপল সাহা বলেন, ওই তরুণ সাংবাদিক নিয়মিত মন্দিরে হিন্দু ধর্মচর্চা ও পূজা করতে আসতেন।
এসব কারণে শনিবার সকাল পর্যন্ত শাবলুল আলম সবুজ শেখ অভিশ্রুতি ওরফে বৃষ্টির লাশ খুঁজে পাননি।
শুরুতে তাকে একবার প্রতারক সন্দেহ করে আটকও করা হয়েছিল। তবে পুরো বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর পুলিশ লাশ হস্তান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে। সেক্ষেত্রে লাশ কুষ্টিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাতে বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজের অগ্নিকাণ্ডে মারা যান অভিশ্রুতি ওরফে বৃষ্টি। তিনি দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের হয়ে নির্বাচন কমিশন বিট কভার করতেন। দুর্ঘটনার আগে এক বন্ধুর সঙ্গে গ্রিন কোজি কটেজের একটি রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলেন তিনি।