আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৎপর হচ্ছে নির্বাচন কমিশন। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহন করছে কমিশন। তবে রাজনৈতিক দলের বিরোধীতার পরও ইভিএমের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়নি অনেক রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন সুধি সমাজ। এর মধ্যে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহন করলে কারচুপি হওয়ার সম্ভব বলে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে (সুজন) সুশাসনের জন্য নাগরিক কিন্তু এ বিষয়ে নিয়ে ভিন্ন কথা বলেছে নির্বাচন কমিশন। ইভিএম ব্যবহার না করতে ৩৯ বিশিষ্ট নাগরিকের আহ্বানের বিষয়ে যা জানাগেল।
আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার আহ্বান জানিয়েছেন দেশের ৩৯ জন নাগরিক। তারা সর্বোচ্চ দেড় শ আসনে ইভিএম ব্যবহারে ইসির নেয়া সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
মঙ্গলবার (৬ সেপ্টেম্বর) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে ৩৯ জন নাগরিকের এই অবস্থান তুলে ধরা হয়। বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটে ইভিএম কিনতে বিপুল ব্যয় কতটা যুক্তিযুক্ত তা বিবেচনা করারও অনুরোধ করেন তারা।
বিবৃতিতে বলা হয়, রাজনৈতিক মতৈক্য ছাড়াই আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ভোট গ্রহণের জন্য ইভিএম ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। কমিশনের এই সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক বলে আমরা মনে করি। এটি রাজনৈতিক বিতর্ককে আরও উসকে দেবে এবং কমিশনের বর্তমান আস্থার সংকটকে আরও প্রকট করে তুলবে। আমরা আবারও একটি ব্যর্থ নির্বাচনের শিকার হব, যা একটি জাতি হিসেবে আমাদেরকে ভয়াবহ সংকটের মধ্যে নিমজ্জিত করবে।
কমিশনের সিদ্ধান্তের অযৌক্তিকতার বেশ কিছু কারণও তুলে ধরা হয়েছে বিবৃতিতে। তিনি বলেন, প্রযুক্তিগতভাবে ইভিএম একটি দুর্বল ডিভাইস। এটিতে ‘ভোটার ভেরিফাইড পেপার অডিট ট্রেল’ (ভিভিপিএটি) নেই, যার অর্থ কমিশন ঘোষিত ফলাফল চূড়ান্ত এবং পুনরায় গণনা বা নিরীক্ষা করা যাবে না। এ কারণে কমিশন কর্তৃক গঠিত কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান প্রয়াত জামিলুর রেজা চৌধুরী ২০১৮ সালে ইভিএম কেনার সুপারিশে স্বাক্ষর করেননি।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, প্রযুক্তির কারণে ইভিএম ব্যবহার করেও ডিজিটাল জালিয়াতি করা যায়। বায়োমেট্রিক-ভিত্তিক ইভিএম অনেক ভোটারকে শনাক্ত করতে পারে না, তাই কমিশন প্রিসাইডিং অফিসারদের তাদের আঙুলের ছাপ দিয়ে মেশিনটি আনলক করার এবং ইভিএমগুলিকে ওভাররাইড করার ক্ষমতা দেয়। যেকোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মতো, ইভিএম ফলাফলও প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে হেরফের করা যেতে পারে। এ ছাড়া নির্বাচনের সময় মাঠপর্যায়ে মোতায়েন করা কারিগরি দলও নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন করতে পারে। গত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অন্তত দুইবার ফল প্রকাশের অভিযোগ উঠেছে, যা কেবল ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমেই সম্ভব। এছাড়া অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে ইভিএম ব্যবহারের কারণে ভোটাররা ভোটাধিকার বঞ্চিত হয়েছেন।
৩৯ জন নাগরিকের বিবৃতি অনুসারে, সম্প্রতি কমিশনের ডাকা সংলাপে ইভিএম নিয়ে যে ২২টি দল তাদের মতামত প্রকাশ করেছে, তাদের মধ্যে ১৪টি দল স্পষ্টভাবে এটি নিয়ে তাদের সন্দেহ ও সংশয় প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে ৯টি দল সরাসরি ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করেছে। আওয়ামী লীগসহ চার দল ইভিএমে ভোট চেয়েছে। অন্যদিকে বিএনপিসহ যে ৯টি দল ইসির সংলাপ বয়কট করেছে তারাও ইভিএমের বিপক্ষে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল নিজেই সংলাপে বলেছেন, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমে বিশ্বাস করে না। তাই ইভিএম নিয়ে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের এই অবিশ্বাস আগামী নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
নতুন ইভিএম কেনা ন্যায়সঙ্গত হবে কিনা তা বিবেচনা করতে বলে বিবৃতিতে বলা হয়, একাদশ নির্বাচনের আগে ইভিএম কেনার জন্য ৩৫০০ কোটি টাকা ($৪৫০ মিলিয়ন ডলার) খরচ হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নতুন মেশিন কিনতে ১৫০টি ইভিএমে নির্বাচন করতে অন্তত অর্ধ বিলিয়ন ডলার খরচ হবে।
প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা এবং ভোটারদের আস্থার অভাবের কারণে বিশ্বের অনেক দেশ এখন ইভিএম ব্যবহার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত জার্মানি, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসও ইভিএম ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের ১৭৮টির মধ্যে ১৩টি দেশ তাদের সব নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে।
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান ও আকবর আলী খান, বিচারপতি মোঃ আব্দুল মতিন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন। , সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ, কেন্দ্রীয় মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পারভীন হাসান, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ, আইনজীবী শাহদীন মালিক, অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। , আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অর্থনীতিবিদ আহসান মনসুর, সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মণ্ডল, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, প্রকৌশলী বিডি রহমতুল্লাহ, আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল আহমেদ, অধ্যাপক ড. . , সাধনা শৈল্পিক পরিচালক লুবনা মরিয়ম, অধ্যাপক স্বপন আদনান, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ, অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম, সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, সাংবাদিক কামাল আহমেদ, সিটিজেন ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, মানবতা কর্মী লিমিটেডের নেতা লিটন খান প্রমুখ। , মহিলা দলের সদস্য শিরীন হক, সুজন সাম পদক বদিউল আলম মজুমদার, আইটি সাইফুর রহমান, আর্টিকেল নাইনটিনের আঞ্চলিক পরিচালক ফারুক ফয়সাল, বাংলাদেশ ট্রাইবাল ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী, মোনাশ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ ও সিনিয়র সফটওয়্যার সল্যুশন আর্কিটেক্ট ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব।
প্রসঙ্গত, রাজনৈতিক দলসহ দেশের বিশিষ্টজনেরা নির্বাচন পদ্ধতিতে ইভিএমের ব্যবহারের বিপক্ষে তাদের সংশয় নির্বাচনে এটি ব্যবহার করলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও নাজুক হবে। তাছাড়া বিগত নির্বাচন দুটি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে এতে করে আবারও নির্বাচন বিতর্ক হলে সার্বিক পরিস্থিতি মঙ্গলকর হবে না।