বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে রয়েছে অনেক চৌকস কর্মকর্তা। যারা দেশের জন্য কাজ করে গেছে একটা সময়ে। আবার এমন অনেক সেনাকর্মকর্তা আছেন যাদের ক্যারিয়ার একেবারেই বিতর্কিত।আর তাদের মধ্যেই একজন মেজর জিয়াউল আহসান। তাকে নিয়েই ধারাবাহিক ভাবে লেখনী লিখে যাচ্ছেন আরেক সাবেক সেনা কর্মকর্তা মুস্তাফিজুর রহমান। পাঠকদের উদ্দেশ্যে তার সেই ধারাবাহিক লেখনীর ৬তম পর্ব তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য:-
জিয়াউল আহসান পর্ব-৬
মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান সেনাবাহিনী থেকে প্রথম প্রেষনে র্যাবে পোস্টেড হয় ২০০৯ সালে। র্যাব-২ এর উপ অধিনায়ক হিসাবে মোহম্মদপুরে র্যাব ক্যাম্পে সে জয়েন করে।
সেই ২০০৯ ই তার শেষ সেনাবাহিনীতে চাকুরী মেজর পদবীতে। মেজর থেকে সে একে একে মেজর জেনারেল পদবীতে উন্নীত হয় সেনাবাহিনীর বাইরেই। এটা নিশ্চয়ই যে কোন সেনাবাহিনীর ইতিহাসে একটি রেকর্ড! সেনাবাহিনীতে জীবনের প্রথম তিনটি প্রাইমারি পদবীর পর পরবর্তী চারটি পদবীই সেনাবাহিনীর বাইরে থেকে। সম্প্রতি একজন চাকুরীরত মেজর জেনারেল জানান বর্তমান সরকারের নীতি অনুযায়ী প্রতি কোর্সে ১/২ দুইজন প্রকৃত যোগ্যতা সম্পন্ন অফিসার প্রমোশন পেয়ে মেজর জেনারেল হতে পাবে আর বাকীদের যদি সরকারের/জাতীয় পর্যায়ে কোন বিশেষ অবদান থাকে তবেই তিনি মেজর জেনারেল পদে প্রমোশন পেতে পারেন।
আমরা সবাই জানি জাতীয় পর্যায়ে জিয়াউল আহসানের ঠিক কী কী বিষয়ে অবদান আছে। বর্তমান সরকার তথা দলের জন্য হুমকী স্বরুপ যে কাউকে হুমকী ধামকী তার প্রধান কাজ। এই হুমকীতে কাজ না হলে শেষ পর্যন্ত গুম খু’ন’ করে সরকারের স্বৈরশাসন রক্ষাকল্পে সহায়তা করা।
জিয়াউল আহসান প্রথমে মোহম্মদপুর র্যাব ক্যাম্পে জয়েন করে সেখানকার আওয়ামীলীগ গডফাদার জাহাংগীর কবির নানকের সাথে সখ্যতা স্থাপন করে। না চাইতেই এমন সাগরেদ পেয়ে নানক সেই বছরে প্রথম তার প্রতিপক্ষের দুইজনকে (তেজগাঁও পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের ছাত্র) জিয়াকে দিয়ে ক্রসফায়ার করায়। এই হ’ত্যা’কা’ণ্ড দুইটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করার পর এবং হ’ত্যা’কা’ন্ড পরবর্তী মিডিয়া ম্যানেজমেন্টে জিয়া দক্ষতার পরিচয় দিলে সে নানক তথা আওয়ামী লীগ সরকারের নেক নজরে আসে। সরকার তো এমন লোকেদেরই খুঁজছিল! সরকার দেখলো যে জিয়াউল আহসানের ভিতরে রয়েছে ব্যক্তিগত নীতিহীনতা, কমান্ডোর দক্ষতা আর সেনাবাহিনীতে উপরে ওঠার সুতীব্র উচ্চাশা- এমন অফিসারই তো খুঁজে ফেরে সরকার। একেবারে জ্যাকপট পাওয়া গেছে। এখন আর সরকার নিয়ন্ত্রিত অদক্ষ ক্রিমিনালদের দিয়ে তাদের ডার্টি ওয়ার্ক করাতে হবেনা, জিয়াই ধীরে ধীরে হয়ে উঠল সরকারের আজ্ঞাবাহক কিলার। জিয়া ধীরে ধীরে তার রাজনৈতিক প্রভাব আর ক্রুরতা কাজে লাগিয়ে তৈরী করল নিজের নিয়ন্ত্রিত র্যাব। পুরষ্কার হিসেবে সে প্রমোশন পেয়ে লে: কর্নেল পদবীতে র্যাব গোয়েন্দা শাখার প্রধান হয়। এবারে তার হাতে এলো নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। র্যাব গোয়েন্দা শাখার প্রধান হয়ে শক্ত হাতে বিরোধীদল দমনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় ধীরে ধীরে তার প্রভাব বৃদ্ধি পায়। এইসময় সে র্যাবের অপারেশন কার্যক্রমে কিছু পরিবর্তন আনে এবং র্যাবের পুরো অপারেশনাল কন্ট্রোল তার নিজের হাতে নিয়ে নেয়।
পাঠকের বুঝার সুবিধার্থে একটু বিস্তারিত বলি। র্যাবের অবকাঠামো তৈরী হয়েছে কিছুটা সামরিক এবং কিছুটা আইনশৃংখলা বাহিনীর অবকাঠামোর সমন্বয়ে। সাধারণ অবস্থায় র্যাবের অপারেশন পরিচালিত হবার কথা পরিচালক অপারেশনস্ এর মাধ্যমে। তিনি র্যাবের সকল অধিনায়ক এবং ডিজি র্যাবের মধ্যে সেতু বন্ধন হিসাবে কাজ করবেন। পরিচালক ইন্টেলিজেন্স র্যাব সদর এবং অধিনায়কদের গোয়েন্দা সহায়তা প্রদান করবেন। জিয়াউল আহসান তার রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে র্যাবের সকল অপারেশন এবং অধিনায়কদের কন্ট্রোল নিয়ে নেয়। অথচ প্রটোকল অনুযায়ী ডিজি এবং এডিজির পর অধিনায়কদের অবস্থান হবার কথা। বাস্তবে জিয়া র্যাবের সকল অধিনায়কদের কন্ট্রোল করতো। র্যাবে তৎকালীন চাকুরীরত জিয়ার কয়েকজন সিনিয়র অফিসার এ বিষয়ে কঠোর অসেন্তোষ প্রকাশ করেন এবং একজন অফিসার র্যাব থেকে নিজ ইচ্ছায় সেনাবাহিনীতে প্রত্যাবর্তন করেন। এ সময় র্যাবে জিয়ার অবস্থান এতটাই শক্তিশালী ছিল যে ডিজি র্যাব বা এডিজি র্যাব জিয়ার মতামতকে বেদ বাক্যের মত মেনে নিতেন। সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর এবং জিয়া পূর্বে একে অপরকে সহ্য করতে পারতেন না। এর কারণ মূলত: বেনজীরের কঠোর এন্টি মিলিটারি মনোভাব। জিয়া আমাকে বেশ কয়েকবার বলেছে বেনজীর ঢাকা মেট্রোপলিটনের কমিশনার থাকা অবস্থায় বেশ কয়েকটি পুলিশ সমমনাদের মিটিং এ এন্টি আর্মি বক্তব্য দেন। তবে বেনজীরকে ডিজি র্যাব হিসাবে পোস্টিং দেবার জন্য সরকার মনোনীত করলে রাজনৈতিক পর্যায়ে দুইজনের ভিতর আপোস করানো হয়। জিয়া এবং বেনজীর উভয়েই তখন একে অপরের ক্ষমতা এবং নিজেদের ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করে আপোস করেন।
জিয়া আওয়ামী লীগ সরকারের শাসন আমল শান্তিপূর্ণ রেখেছে তাইতো? একটা বিষয় গভীরভাবে খেয়াল করুন, গত ১৪/১৫ বছরে সেনাবাহিনীতে কী কী গুণগত পরিবর্তন দেখেছেন? সেনাবাহিনীতে আমাদের যুদ্ধ জয়ের একটি প্রধান হাতিয়ার কমরেডশীপ ধ্বংশ করে দেয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণকালীন সময়ে আর যুদ্ধের কঠোর সময়ে আমাদের পাশে থাকবে আমাদের সহযোদ্ধারা সেখানে আমাদের মা-বাবা-ভাই-বোন কিংবা আত্মীয় স্বজন কেউই থাকেনা। এই সহযোদ্ধারাই আমাদের প্রকৃত বন্ধু, স্বজন। আমরা অফিসার/অধিনায়ক হিসাবে সৈনিকদের শিক্ষা দিই তাদের বিপদে আমরা সবার আগে এগিয়ে যাবো। আবার সেই সৈনিকরাই আমাদের যে কোন বিপদে তাদের জীবন দিতে প্রস্তুত থাকে। আমি এ বিষয়ে আমার নিজের সহ আমার দেখা অসংখ্য উদাহরণ দিতে পারবো।
বলতে লজ্জাবোধ হচ্ছে যে, আমার প্রাক্তন বন্ধু জিয়াউল আহসান আমাদের মিলিটারি কমরেডশীপ ধ্বংশ করার একজন প্রথম সারির কারিগর।
বিডিআর হ’ত্যা’কা’ণ্ড থেকে শুরু করে মেজর হেলাল সহ পাঁচজন অফিসারের বিষয়ে, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আজমী, লে: কর্নেল তৌহিদ স্যার থেকে উইং কমান্ডার ওয়াহেদুন্নবী থেকে এমন আরও অসংখ্য উদাহরণ আছে তার নিজ গোত্রের মানুষকে উঠিয়ে নিয়ে নির্যাতন বা তার নেপথ্যের কারিগর থাকার। আপনি অন্যান্য আইনশৃংখলা বাহিনীর দিকে খেয়াল করুন তো কোন উদাহরণ খুঁজে পান কিনা যেখানে পুলিশ নিজে অন্য পুলিশ অফিসারকে তুলে নিয়ে এসে নির্যাতন করার? অথবা একজন আনসার অন্য একজন আনসারকে তুলে নিয়ে এসে শিক্ষা দেবার! আমি হলফ করে বলতে পারি, একজনও খুঁজে পাবেন না। কাক কী কখনো কাকের মাংস আহার করে??
কিছুদিন আগে আমি যখন লে: কর্নেল তৌহিদ স্যারকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করার পিছনে জিয়ার হাত আছে লিখার পর সেখানে অসংখ্য কমান্ডো অফিসার/সৈনিক মন্তব্য করার পর জিয়া অসন্তুষ্ট হয়ে কিছু অবসরপ্রাপ্ত কমান্ডো সৈনিকদের বলে “তোরা যদি তৌহিদ স্যারকে এতই পছন্দ করিস তবে বিপদে পড়লে তৌহিদ স্যারের কাছেই যাইস! আমার কাছে আর আসিস না; এখন থেকে তোদের আর আমি কোন হেল্প করব না” জিয়া সেনাবাহিনীর অনেক অফিসার/সৈনিককে র্যাবে পোস্টিং করে এনে তাদের দিয়ে গুম খুন করিয়েছে। আর তাদের দিয়েই সেনাবাহিনীর অফিসারদের ধরে এনে গুম খুন আর নির্যাতন করিয়েছে।
মহাভারতের অত্যাচারী রাজা কংসের গল্পটা মনে আছে?
কংস তার নিজের বাবা রাজা উগ্র সেনকে বন্দী করে মথুরার রাজা বনে যান……….. । কংস রাজা তখন যোগমায়াকে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করতে আদেশ দেন। কিন্তু যোগমায়া নিক্ষিপ্ত অবস্থায় বলে উঠেন, ‘তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে’।
এই গল্পের শেষটা তো আপনারা জানেন। গোকুলে বেড়ে ওঠা শ্রীকৃষ্ণ বড় হলে, শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণের হাতেই কংসের পতন ঘটে!
এই গল্পটা বলার কারণ হলো, শুধু জিয়াউল আহসান নামক মানুষরূপী দানব নয় এই পাপিষ্ঠ-স্বৈরাচারী একনায়ক সরকারের পতন ঘটাবার জন্য রক্তবীজের ঝাড় বাড়ছে বাংলায়। বরিশাল, চট্টগ্রাম, রংপুর খুলনা আর ময়মনসিংহে জনতার মহাসমুদ্র দেখেও কী তাদের মনে পড়েনা, তোমারে বধিবে যারা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ায় বাড়ছে তারা!
সত্য সমাগত মিথ্য বিতাড়িত
প্রসঙ্গত,এর আগেও মেজর জিয়াউল হকের আরো বেশ কয়েকটি পর্ব লিখেছেন।যেখানে তিনি তুলে ধরেছেন সেনাবাহিনীর অনেক অন্ধকার দিক এবং সেই সাথে জড়িত অনেকের নাম।