বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের ঐক্যবদ্ধ ভাবে আন্দোলনে নামার বিষয়টি নিয়ে কোন ধরনের আলোচনায় নেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক কর্নেল অলি আহমেদ বীর বিক্রম। তিনি এ বিষয় নিয়ে দেশের একটি জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তিনি তার সাক্ষাৎকারে বলেন, জাতির বৃহত্তর কল্যাণের জন্য জামাতের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনের জন্য বলেছি। আমার কাছে যেটা ভালো মনে হয়েছে আমি সেটাই বলেছি। তবে এটা বিএনপি মেনে নেবে কি নেবে না সেটা বিএনপি’র ব্যাপার। শনিবার রাজধানীর মহাখালীতে কর্নেল (অব.) অলি আহমেদের সঙ্গে তার বাসায় কথা হয় চিফ করেসপন্ডেন্ট লোটন একরাম।
সংবাদ মাধ্যম: নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে ডান-বাম-ইসলামী সমমনা দলগুলোর সঙ্গে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার উদ্যোগের মূল্যায়ন কী?
অলি আহমদ: বিএনপিসহ আমরা সবাই খুব সতর্কতা ও সুচিন্তিতভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বিএনপি ও জামায়াত একসঙ্গে মাঠে থাকলে আওয়ামী লীগের অবস্থা হবে ত্রিমুখী।
সংবাদ মাধ্যম: বিতর্কিত জামায়াতকে দূরে রেখে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়তে সমমনা প্রগতিশীল দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসছে বিএনপি। সম্প্রতি আপনি বলেছেন, এলডিপি, নাগরিক ঐক্য ও জামায়াতও বিএনপির নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে থাকবে। তারপরও একই কথা বলছি- এর যৌক্তিকতা কী?
অলি আহমদ: এই মুহূর্তে সবার দায়িত্ব দেশ রক্ষা করা। তাই দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। অন্য কোন উপায় নেই। যুদ্ধাপরাধীদের আমি কখনও কদমবুসি করিনি। আওয়ামী লীগ তাদের কদমবুসি করেছে। একযোগে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময়, ১৯৮৬-৮৭ সালে এরশাদের অধীনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত একসঙ্গে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। এর বাইরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ১৯৯৫ সালে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত ঐক্যবদ্ধভাবে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। তখন জামায়াত নিয়ে আওয়ামী লীগের কোনো আপত্তি ছিল না। বাস্তবতাকে অস্বীকার করার কিছু নেই।
সংবাদ মাধ্যম: আপনার বক্তব্যে বিএনপির শীর্ষ নেতারাও নাখোশ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলছে ব্যাপক সমালোচনা। কেউ কেউ মনে করছেন, নির্বাচনী এলাকায় জামায়াতের ভোট আকর্ষণের কৌশল এটি। কেউ কি সরাসরি কিছু বলেছে?
অলি আহমদ: আমার নির্বাচনী এলাকায় অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের আধিপত্য নেই। আল্লাহর রহমতে ১৯৮০ সাল থেকে কেউ আমাকে পরাজিত করেনি। ৮০ শতাংশ মানুষ আমাকে সমর্থন করে। এমনও হতে পারে চট্টগ্রাম-১৫ আসন নিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে কথা বলেছেন তারা। আসলে আমার নির্বাচনী এলাকা চট্টগ্রাম-১৪। এ বিষয়ে বিএনপির কারো সঙ্গে আমার কোনো কথা হয়নি।
সংবাদ মাধ্যম: যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতের সঙ্গে যৌথ আন্দোলনে প্রগতিশীল বাম দলগুলোর তীব্র আপত্তি। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বীর হিসেবে জামায়াতের সাথে আপনার বিরোধের কারণ কী?
অলি আহমদ: জামায়াত দেশের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। তারাও নিসিরাতের বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছেন। বিরোধী দলের সবাই এই অবৈধ সরকারের হাত থেকে মুক্তি চাই। বাম-ডান এবং উত্তর-দক্ষিণদের দাবি প্রায় একই। আমরা নিজ নিজ জায়গা থেকে আমাদের কর্মসূচি পালন করছি। মানুষের বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য অনেক কিছু অপছন্দ হলেও মেনে নিতে হয়। বিএনপি ও আমাদের পক্ষ থেকে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, সরকারবিরোধী দলগুলো ন্যূনতম ঐকমত্যের ভিত্তিতে নিজ নিজ জায়গা থেকে সরকার পতনের আন্দোলনে অংশ নেবে। আন্দোলনের বিষয়বস্তু এখনো এক পর্যায় থেকে আসেনি।
এ ছাড়া জামায়াতও গণমাধ্যমকে বলেছে, তারাও এই সরকার সরাতে চায়। নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। সংসদ বাতিল চায়। প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন চায়। বিরোধী দলগুলোর দাবি ৯০-৯৫ শতাংশ একই। সবার স্লোগান ‘হঠাও সরকার বাঁচাও দেশ’।
সংবাদ মাধ্যম: ২০১৯ সালের শুরুতে আপনি জামায়াতকে নিয়ে ‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’ নামে একটি পৃথক প্লাটফর্ম তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এমনকি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে সোচ্চার আন্দোলনের ঘোষণা দেন। তবে বিএনপির বিরোধিতার কারণে শেষ পর্যন্ত সেই উদ্যোগ বেশিদূর এগোয়নি।
অলি আহমদ: এটা ঠিক নয়, আমি বিএনপির ক্ষতি করার কোনো উদ্যোগ নিইনি। বরং বিএনপির হাতকে শক্তিশালী করতে এবং খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে আমরা যৌথভাবে সেই উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এটা আলাদা জোট বা বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ছিল না।
সংবাদ মাধ্যম: উদ্যোগটিকে ‘মা খালার চেয়ে বেশি কোমল’ বলেও মন্তব্য করেছেন অনেকে।
অলি আহমেদ: ওই অর্ধশিক্ষিতরা জিয়া ও তার পরিবারের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। ফেস”বুক ও গুগলের কারণে এখন অনেক ‘গরু-ছাগল’ও নিজেদের ‘হাতি’ মনে করে।
সংবাদ মাধ্যম: বিএনপির সঙ্গে আপনার দলের সংলাপের সময় একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ হিসেবে আপনি নতুন বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের শীর্ষ নেতা হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। আপনি বিষয়টি সম্পর্কে কিছু স্পষ্ট করতে পারেন?
আলী আহমদ: এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। সরকারের কিছু এজেন্ট বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য এ ধরনের বক্তব্য দেয়। এমন আলোচনা আমাদের কোথাও হয়নি। আমি আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। আমার ব্যক্তিগত বিষয় এখানে প্রাধান্য পাবে না। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জনগণের পাশে দাঁড়ানোর দায়িত্ব আমার।
সংবাদ মাধ্যম: বিভিন্ন বক্তব্য ও উদ্যোগের মাধ্যমে আপনি রাজনীতিতে মাঝে মাঝে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন- এর পেছনের রহস্য কী?
অলি আহমদ: একটি দলের প্রধান এবং ৭১ সালের প্রথম বিদ্রোহী হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব এড়াতে পারি না। আমার দৃষ্টিতে যা ভালো এবং মানুষের জন্য ভালো হবে, আমি অকপটে বলি। কে শুনলো, কে শুনলো না- এটাই তাদের ব্যাপার।
সংবাদ মাধ্যম: দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বের বিরোধিতা ও নানা অভিযোগ তুলে দল ছেড়েছেন বিএনপির বর্তমান কান্ডারি। এমনকি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের সদস্য হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। তারেক রহমানের নেতৃত্বে জোটে থাকার যৌক্তিকতা কী?
অলি আহমদ: আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে কখনো নির্বাচন করিনি। আমি ২০০৯ সালে দলের ছাতা প্রতীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আল্লাহর রহমতে বিজয়ী হয়েছিলাম। আর যেহেতু আমি কখনোই দুর্নীতি ও অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত নই, তাই সংশ্লিষ্ট কারণে অনেকেই আমার বিরোধিতা করছেন। এটা তাদের অধিকার। আর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনুরোধে ২০১০ সালে এলডিপি বিএনপি জোটে যোগ দেয়। সে সময় বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট ছিল। এলডিপি নির্বাচন কমিশনে একটি স্বতন্ত্র এবং এক নম্বর নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল।
সংবাদ মাধ্যম: রাজনীতির নতুন মেরুকরণের প্রস্তাবে আপনি সম্প্রতি দলের মহাসচিবের সঙ্গে গোপন বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে কয়েকদিন আগে থাইল্যান্ডে যান বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের কয়েকজন নেতা। আপনার যুক্তি কী?
আলী আহমেদ: ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন মত আছে, সবার মুখ আছে। তিনি যা খুশি বলতে পারেন। তাদের চুপ করানোর অধিকার আমার নেই। সবাই রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। এটা তাদের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক স্বাধীনতা।
সংবাদ মাধ্যম: বিএনপির রূপরেখা নিয়ে কিছু বলুন?
অলি আহমেদ: আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক মান উন্নয়নের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমাদের মধ্যে কোনো মতপার্থক্য নেই। বর্তমান অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে সবাই মুক্তি চায়।
সংবাদ মাধ্যম: বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে সংকট রয়েছে বলে দাবি করে আসছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তারাও প্রশ্ন তুলছেন আন্দোলন ও নির্বাচনে বিএনপির শীর্ষ নেতা কে?
আলী আহমদ: আওয়ামী লীগ এ নিয়ে এত চিন্তিত কেন? বিএনপির ইস্যু ঠিক করবে বিএনপি। বিএনপি দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। কখন কী করতে হবে তা তারা ভালো করেই জানে।
সংবাদ মাধ্যম: রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের নেপথ্যে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির শীর্ষ নেতাদের হু’মকি-পাল্টা হু’মকি কি কর্মীদের উ”স্কানি দেওয়া হচ্ছে না?
অলি আহমদ: রাজনীতি তার গতিপথে যাক। সবকিছুকে স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিতে হবে। এদেশের মানুষকে দাসত্বে বাধ্য করা যায়নি। অচলাবস্থায় মাঠে নেমেছে বিএনপি ও বিরোধী দলগুলো। বর্তমান অবৈধ সরকার সময়মতো সরে না গেলে ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে। বিএনপিসহ বিরোধী দলের প্রতিটি কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ ও পুলিশ যৌথভাবে হা”মলা ও গু”লি চালাচ্ছে। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে বিরোধী দলগুলোর কর্মসূচি গতি পাচ্ছে। আওয়ামী লীগকে বুঝতে হবে তাদের দিন শেষ।
সংবাদ মাধ্যম: বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আপনার সার্বিক মূল্যায়ন কী?
অলি আহমদ: বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংকটজনক ও অস্বস্তিকর। কখন কী হবে, কেউ বলতে পারে না। বাংলাদেশ অতীতে কখনোই ত্রিভুজ রাজনৈতিক অবস্থানে ছিল না। ভৌগোলিক কারণে এবং আওয়ামী লীগের দুঃশাসন ও দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ বর্তমানে এক ভয়াব’হ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখানে আমি ত্রিভুজ রাজনীতি সম্পর্কে একটি ব্যাখ্যা দিতে চাই- একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত এবং অন্যদিকে চীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্থান রুট নিয়ন্ত্রণ করে। বর্তমান সরকার তিন দেশের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে সমুদ্র বিপদে পড়েছে। ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ উভয় সংকটে পড়েছে।
বর্তমান সরকার এই সমূহ বিপদের থেকে কোনভাবে সরে যাওয়ার উপায় নেই। সেই সাথে দেশে শুরু হয়েছে ডলারের সংকট। রাষ্ট্রের মূল শক্তি জনগণ, আর এই জনগন এখন সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছে, দুর্নীতি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে, মানিলন্ডারিং সহ অনেক অনেক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে দেশ। আ.লীগ জনসমর্থন হারিয়েছে, যার কারণে তারা পুলিশ ব্যবহারের মাধ্যমে সবকিছু চাপিয়ে দিচ্ছে জনগণের ওপর। পরিস্থিতি আস্তে আস্তে খারাপ হলে সরকারের এ ধরনের পরিকল্পনা আর বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে না।