তার নাম মুক্তা রায় হলেও সবাই তাকে মুক্তা সেন নামেই চেনে। পাঁচ হাজার টাকায় আয়া পদে চাকরি করে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি৷ চলতি বছরে এক ব্যাংক হিসাব নম্বরে লেনদেন করেছেন ২০ কোটি টাকা৷ ঢাকায় গাড়ি-বাড়ি, নিজ জেলায় প্লট আকারে জমি, রেস্টুরেন্ট, কারখানা ও বাগানসহ ভারতে রয়েছে বাড়ি-গাড়িসহ বিশাল মার্কেট।
এত কিছুর মালিক হয়েছেন সাবেক মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনের কারণে। জমি দখল, ঘুষ, হাসপাতাল টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানা অপকর্মের মাধ্যমে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন সাবেক মন্ত্রী রমেশ সেনের দ্বিতীয় স্ত্রী মুক্তা সেন।
স্বামী মারা যাওয়ার পরে দিকবিদিক শূন্য হয়ে পড়েন মুক্তা রায়। চাচাতো ভাই দুলালের মাধ্যমে আয়া পদে চাকরি শুরু করেন সিভিল সার্জন অফিসে৷ চাকরিরত থাকা অবস্থায় সংখ্যতা গড়ে ওঠে সাবেক মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনের সঙ্গে৷ তারপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। চার বছরের মাথায় ছেড়ে দেন সেই চাকরি৷ মুক্তা রায় থেকে হয়ে উঠেন রমেশ সেনের বউ খ্যাত মুক্তা সেন৷ শুরু হয় মুক্তা সেনের কোটিপতি হবার উত্থান।
মুক্তা সেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার প্রজেয়া ইউনিয়নের চাখালদী গ্রামের বাসিন্দা তার স্বামী আদালতের উশর হিসেবে কাজ করতেন, যা উপার্জন হতো তা নিয়ে সংসারে সবসময় টানাপোড়েন থাকত। স্বামীর মৃত্যুর পর, তিনি তার দুই সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আয়া হিসেবে চাকরি নেন। পরে আয়া পদ থেকে চাকরি ছেড়ে নজর দেন ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হাসপাতালের কেনাকাটা, খাবার, আউটসোর্সিং-এ নিয়োগ বাণিজ্য করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া শুরু করেন৷ তারপর থেকে হাসপাতালের সব নিয়ন্ত্রণের নিয়ে হয়ে উঠেন হাসপাতালের রাণী মুক্তা সেন।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঢাকায় দুটি ফ্ল্যাট, কার রেন্ট-এ সেন্টারের শো-রুম, ঠাকুরগাঁও পৌরশহরের ইসলামবাগে দুই তলা বাড়ি, শান্তিনগরে দুই জায়গায় প্লট আকারে ৫ শতক করে জমি, পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলএসডি গোডাউনের পাশে ১০ শতক জমি, পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও মহাসড়কের পাশে 3PM রেস্টুরেন্ট৷
সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের বাদুপাড়ায় বাড়ি-জমি ও সয়াবিন তেলের কারখানা, চন্ডিপুরে জমিসহ বাড়ি, মিল-চাতাল ও পুকুর ২ কোটি ৮ লাখ টাকায় কেনার জন্য ৩০ লাখ টাকা অগ্রীম, আবাদি জমি রয়েছে ২০ বিঘা। সদরের গড়েয়া বাসস্ট্যান্ডে ৮ শতক জমির ওপরে বাড়ি৷
এ ছাড়াও নিয়োগ বাণিজ্য, জমি দখলসহ নামে-বেনামে সম্পত্তি ও বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হোল্ডার রয়েছেন। সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের নওগাঁর অটো রাইস মিল কয়েক কোটি টাকায় কিনেছেন এই মুক্তা সেন৷
চলতি বছরে মুক্তা সেনের দুই ছেলে তূর্য ও মাধুর্য এন্টারপ্রাইজ নামে পূবালী ব্যাংক হিসাব নম্বরে লেনদেন হয়েছে ২০ কোটি ৩৮ লাখ ২০৯৯ টাকা। সাবেক মন্ত্রী ও এমপি রমেশ চন্দ্র সেন আটক হওয়ার পর দিন সব টাকা তুলে নিয়ে বর্তমানে রয়েছে ৬ হাজার ৪১৭ টাকা। এ ছাড়াও জনতা,অগ্রণী ও সোনালী ব্যাংকেও তাদের হিসাব নম্বরে দুই বছরে লেনদেন রয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা।
নিজের আখের গুছিয়ে ক্ষান্ত হননি এই মুক্তা সেন৷ ভাইদের রাজনীতিতে যুক্ত করে ঠিকাদারি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করে দেন। আর ভাতিজা-ভাতিজিদের সরকারি চাকরিও নিয়ে দিয়েছেন এই মুক্তা সেন৷
হত্যা মামলায় ভারতে পলাতক থাকা বড় ভাই নারায়ণ ঠাকুরকে এসে যুক্ত করান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে৷ মন্ত্রীর প্রভাব আর রাজনৈতিক দাপটে তারা হয়ে উঠেন আরো প্রভাবশালী। তার খালাতো ভাই দুলালকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, খালাতো বোনের ছেলে নিপুণকে হাসপাতালের ঠিকাদারি, বোনের মেয়ে মৌ কে স্কুলের শিক্ষিকা, আরেক বোনের ছেলে জয়কে ফোর্সসহ রাজস্ব ও আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে জেলার বিভিন্ন সরকারি দফতরে চাকরি দিয়েছেন তার দুই শতাধিক আত্মীয়-স্বজনকে৷
আরেক বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমরা সবাই তাকে এমপির দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে চিনতাম। এলাকায় জমি, তার ভাই ও বোনদের সেই সঙ্গে আত্মীয়-স্বজনদের চাকরি দিয়েছেন৷ তাদের বংশের সবার চাকরি হয়েছে। এলাকার স্কুলগুলোতে অনেককে চাকরি দিয়েছে। তার বিনিময়ে টাকা নিয়েছে আবার কারো কাছে জমি নিয়েছে৷ পাশেই মিল চাতাল পুকুর ২ কোটি ৮ লাখ টাকায় কেনার জন্য ৩০ লাখ গত মাসে অগ্রিম দিয়েছে৷ কয়েক বছর আগেও যার নুন আন্তে পান্তা ফুরিয়ে যেত সেই মুক্তা এখন শত কোটি টাকার মালিক।
ঠাকুরগাঁওয়ের সিভিল সার্জন ডা. নুর নেওয়াজ আহমেদ জানান, মুক্তা রায় ২০১০ সালে আয়া পদে যোগদানের পর ২০১৪ সালে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেন।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ঠাকুরগাঁও সমন্বিত কার্যালয়ের উপ-পরিচালক তাহসিন মুনাবিল হক বলেন, আয় বহির্ভূত সম্পদ উপার্জনের কোনো সুযোগ নেই। এর সঙ্গে কেউ জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে