পদ্মা নদী বিশ্বের দ্রুততম প্রবাহিত নদীগুলির মধ্যে একটি। এ নদীতে প্রবাহিত পানির পরিমাণ, নদীর গভীরতা ও প্রশস্ততা এবং তলদেশের মাটির ধরণ-এর কারণে এর ওপর সেতু নির্মাণ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। এই সেতু তৈরি করতে গিয়ে সম্মুক্ষিন হতে হয়েছিল নানাবিধ জটিলতা, তবে সকল প্রকার জটিলতা এবং প্রতিকুল অবস্থাকে পাশ কাটিয়ে সেই অসম্ভবকে জয় করে প্রসংশায় ভাসছেন আমাদের দেশনেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার দুরদর্শী চিন্তা ধারা এবং অদম্য সাহসিকতাকে পুজিঁ করে সকল বাধা-বিঘ্নকে পেছনে ফেলে আজ বাংলাদেশে স্বপ্নের পদ্মা সেতু দেশের মানষের কাছে দৃশ্যমান। সবকিছু ঠিক ঠাক থাকলে আগামী ২৫শে জুলাইতেই উদ্ধোধন হবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় শিগগিরই ফুলের রাজধানী যশোরের গদখালীর ফুল পৌঁছে যাবে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে। ফেরির জটলায় কোনো ফুলই নষ্ট হবে না। দামও বেশ ভালো। এতে কৃষকরা উপকৃত হবেন। তাই সেতু উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছি। গদখালীর স্থানীয় ফুল বিক্রেতা মিজু মিয়া দক্ষিণের ২১ জেলার মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে গিয়ে এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, দেশের ফুলের চাহিদার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ যশোর থেকে সরবরাহ করা হয়। এ অঞ্চলে প্রায় ১৫০০ হেক্টর জমিতে প্রায় ৬০০০ কৃষক ফুল চাষ করে। এখান থেকে প্রায় সারা বছরই ফুল পাঠানো হয়। বিশেষ দিন ও উৎসব ঘিরে ফুল বিক্রির রেকর্ডও রয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হলে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টায় ঢাকায় ফুল পৌঁছাবে। ফেরিতে আটকে ফুল নষ্ট হওয়ার ভয় থাকবে না। আবার ফেরির অজুহাতে পাইকারদের কম দাম দেওয়ার দিনও শেষ হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, সেতুটি চালু হলে ঘাটে আর কোনো বিড়ম্বনা থাকবে না। এর মাধ্যমে আমরা অল্প সময়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ফুল পাঠাতে পারব। সাধারণত আমরা এখন সবজির ট্রাক ও যাত্রীবাহী বাসে বান্ডিলে ফুল পাঠাই। সেক্ষেত্রে এখন প্রতি বান্ডিলের দাম তিনশ টাকা। সেতুটি চালু হলে খরচ কিছুটা বাড়তে পারে। সেক্ষেত্রে ‘কস্ট অ্যানালাইসিস’-এর মাধ্যমে ফুলের দাম নির্ধারণ করা হবে। তবে শেষ পর্যন্ত লাভবান হবেন বলে জানান তিনি। পদ্মা সেতু চালু হলে যশোর থেকে উৎপাদিত সবজি দ্রুত রাজধানীতে পৌঁছাবে। কাঠগড়ায় আটকে পড়ার ভয় থাকবে না। এতে কৃষকরাও ভালো দাম পাবেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যশোরের ঐতিহ্যবাহী সবজির হাট বার বাজারের পাইকারি বিক্রেতা মনির হোসেন ভুট্টো বলেন, আমরা চার ঘণ্টার মধ্যে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে সবজি পৌঁছে দিতে পারব। ফলে সময় যেমন বাঁচবে তেমনি সবজি হারানোর আশঙ্কা থেকে আমরা মুক্ত থাকব। তবে কম দামে রাজধানীর মানুষকে সবজি খাওয়ানোর জন্য সেতুর টোলের হার কমানোর পক্ষে মত প্রকাশ করেন তিনি। তার মতে, সেতুর টোলের হার কমলে পরিবহন খরচ কমবে। এভাবে সহজে এবং সস্তায় সবজি ঢাকায় পৌঁছে দেওয়া যায়। ক্রেতারাও সস্তায় সবজি কিনতে পারবেন।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, যশোরে রবি, খরিফ-১ ও খরিফ-২ এই তিন মৌসুমে যথাক্রমে ১৭ হাজার, ১৪ থেকে ১৫ হাজার এবং ৬ থেকে ৭ হাজার হেক্টর জমিতে ফসলের আবাদ হয়। এ সিরিজে প্রায় ৬ লাখ মেট্রিক টন ফসল উৎপাদিত হয়। যশোরের চাহিদা প্রায় ৬ লাখ মেট্রিক টন। উদ্বৃত্ত ঢাকাসহ অন্যান্য জেলায় সরবরাহ করা হবে। এদিকে যশোরের অভয়নগর উপজেলার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম মনে করেন, সেতুটি চালু হলে তিনি ঢাকায় গিয়ে সারাদিনের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরবেন। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধন হলে সকালে রওনা হয়ে সকালে ঢাকায় পৌঁছাতে পারব। দিন শেষে ফিরে আসা সম্ভব হবে। এই সেতুর ফলে ঢাকার সঙ্গে আমাদের দূরত্ব অনেকটাই কমে যাবে। ঘাটে কোনো ঝামেলা হবে না। শুধু নজরুল নয়, যশোরের অধিকাংশ মানুষেরই এমন চিন্তাভাবনা রয়েছে। ফেরির দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হয় ২৫ জুন। জানা গেছে, যশোর থেকে ঢাকা পর্যন্ত সড়কপথে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা সময় লাগে। মাঝে মাঝে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডকে বসে থাকতে হয়। সেতুটি চালু হলে এমন পরিস্থিতির অবসান হবে। মাছ, শাকসবজি, ফুল ও অন্যান্য কাঁচামাল যথাসময়ে পৌঁছে দেওয়া হবে।
এদিকে যশোরের চাঁচড়া এলাকা পরাগ উৎপাদনের জন্য সুপরিচিত। এখানে প্রতি সপ্তাহে চার থেকে পাঁচ হাজার কেজি ১০ প্রজাতির পরাগ উৎপন্ন হয়। স্থানীয় মাছ চাষিদের মতে, দেশে পরাগের মোট চাহিদার অর্ধেকই এই অঞ্চল থেকে সরবরাহ করা হয়। সেতুটি চালু হলে প্রতিদিন প্রায় ৩০ লাখ টাকার পরাগ বিক্রি হবে বলে আশা করছেন এখানকার কৃষকরা। এতে ব্যবসার পরিধি বাড়বে, লাভবান হবে মাছ চাষি, ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। যশোর জেলা মৎস্য হ্যাচারি মালিক সমিতির সভাপতি ফিরোজ খান বলেন, আমাদের এই এলাকায় প্রায় পাঁচ হাজার মাছ চাষী রয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হলে ফেরি টার্মিনালে দুর্ভোগ, পোনা হারানো, পথে চাঁদাবাজি থেকে রক্ষা পাব। সেতুটি চালু হলে ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম ও বরিশালের সঙ্গে বাণিজ্য সহজ হবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পদ্মা সেতুতে পিকআপে টোল খরচ ৬০০-৭০০ টাকা বাড়বে। তবে রুট কমানোয় জ্বালানি তেলের দামও কমবে। এ ছাড়া সড়কের অবস্থা ভালো হওয়ায় পরিবহন খরচ কমবে। তাই পরিবহন খরচ না বাড়ানোর দাবি জানান তিনি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবহন সংস্থা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আজিজুল আলম মিন্টু বলেন, পদ্মা সেতু হলে মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হবে। ফেরি প্রতি বাসে ১৬০০ টাকা খরচ হয়; সেতুর ওপর ২৪০০ টাকা ধার্য করা হচ্ছে। এই খরচ বাড়লেও রাস্তার দূরত্ব কমবে, রাস্তা ভালো হলে রক্ষণাবেক্ষণ খরচও কমবে। আবার দ্রুত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো যায় বলে ট্রিপ বেশি হবে। এতে আয় বাড়বে।
তবে ভাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, বাস সেতু পার হবে না আবার ফেরি পার হবে- এটা শ্রমিকদের বিষয় নয়। মালিকরা যেভাবে গাড়ি চালাতে বলে; আমরা সেই পথেই ছুটব। গাড়ি ভাড়া বাড়বে কি না সেটাও মালিকদের ব্যাপার বলে জানান তিনি। যশোর জেলা ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ট্যাংকলরি (দহন ব্যতীত) শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) লুৎফর রহমান বলেন, ফেরি না ব্রিজ দিয়ে যাবো আমরা এখনো ঠিক করিনি। তবে পদ্মা সেতু পার হলে রাস্তা, সময়, তেল ও ডকে বসার খরচ এক হবে না। তবে অস্বাভাবিক হারে টোল বাড়ানো হয়েছে। সেক্ষেত্রে যারা পণ্য পরিবহন করবে তাদের ইচ্ছাকে আমরা অগ্রাধিকার দেব। যশোর বাস মালিক সমিতির সভাপতি বদরুজ্জামান বাবলু বলেন, আমরা যতদূর বুঝেছি, মালবাহী ট্রাক বিশেষ করে কাঁচামাল সেতু পার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে নড়াইলের কালনা ঘাট পার হতে হয়। কালনা সেতু চালু হলে আমাদের সময় ও দূরত্ব কমে যাবে। আর রাস্তার টোল-ব্রিজের টোলের কারণে খরচটা একটু বেশি মনে হচ্ছে। সরকারের উচিত ছিল ফেরি ভাড়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সেতুর টোল নির্ধারণ করা।
পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক প্রভাব প্রসঙ্গে যশোর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান বলেন, পদ্মা সেতু আমাদের অঞ্চলের অর্থনীতির নতুন দ্বার খুলে দেবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় শিগগিরই ইপিজেড বা অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা বাস্তবায়ন করা হবে। নতুন কারখানা তৈরি হবে, শিল্পের প্রসার ঘটবে। ফলে এ অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম মিলন বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শত ষড়যন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে স্থানীয় অর্থে তার স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছেন। এই সেতু যশোরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। এলাকাবাসীর জীবনযাত্রার মান আরও উন্নত হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
উল্লেখ্য, আগামী ২৫ জুন উদ্বোধন হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা স্বপ্নের পদ্মাসেতু। এই স্বপ্নের পদ্মা উদ্বোধন সেতু করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্ধোধনের পরের দিন থেকেই সেতু দিয়ে সব ধরনের যানবাহন চলাচল জন্য সেতুকে উম্মোক্ত করে দেওয়া হবে। পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে তিন হাজার সমর্থকের কাছে আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে এমনটাই জানা গেছে বিভিন্ন সুত্রের মাধ্যমে। উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছেন সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের প্রস্তুতি নিয়ে গত সোমবার (২০ জুন) এক পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেতু বিভাগের সচিব মো. মঞ্জুর হোসেন এতে সভাপতিত্ব করেন।