বাংলাদেশের রাজনিতীর বর্তমান সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় একটি নাম ব্যরিস্টার রুমিন ফারহানা। যিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদি দল বিএনপির রাজনিতীর সাথে শুরু থেকে জড়িত হয়ে আছেন। সম্প্রতি এ ছাড়াও লেখা-লেখি করে থাকেন ব্যাপক হারে। সম্প্রতি দেশের অন্যতম বড় ও জনপ্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন নিয়ে যে বিতর্ক চলছে তা নিয়ে লিখেছেন লেখনি। পাঠকদের উদ্দেশ্যে তার সেই লেখনি তুলে ধরা হলো হুবহু:-
আমি এতদিন গর্বের সঙ্গে বলে এসেছি, আমি হলিক্রস স্কুল, ভিকারুননিসা নূন কলেজের ছাত্রী। এই দুই প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক অনাদিকাল থেকেই অম্লমধুর। বোর্ড পরীক্ষার রেজাল্ট, এক্সট্রা কারিক্যুলার অ্যাকটিভিটিজ, বিশেষ করে বিতর্কসহ সব ক্ষেত্রে এই দুই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীদের মধ্যে চলে তীব্র প্রতিযোগিতা। তাই হলিক্রস স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে একই কলেজে তিন মাস ক্লাস করার পর যখন ঘোষণা দিলাম আমি কলেজ বদলাবো তখন স্বভাবতই প্রচণ্ড অবাক হয়েছিলেন বাবা-মা। আমার মা তখন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের প্রথম নারী মহাপরিচালক। বাংলাদেশের সব মাধ্যমিক স্কুল এবং কলেজ মায়ের সরাসরি অধীনস্থ ছিল। ভিকারুননিসাও তার ব্যতিক্রম নয়।
আমার জেদের কারণে বাধ্য হয়ে আম্মা ফোন দেন ভিকারুননিসার তৎকালীন অধ্যক্ষ হামিদা আলীকে। হামিদা আলী আপাকে শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয় করতো না, এমন কেউ ছিল না। আম্মা তার সরাসরি বস হওয়া সত্ত্বেও বিনীতভাবে আপা বলে দেন, ভর্তির সময় অনেক আগেই পার হয়ে গেছে, এখন আর সময় নেই, যদি না কোনও ছাত্রী কলেজ পরিবর্তন করে। আমার ভাগ্য সুপ্রসন্নই বলতে হবে, তার মাস খানেকের মাথায় আম্মা আমাকে জিজ্ঞেস করেন আমি যদি চাই কলেজ বদলাতে পারি। হামিদা আলী জানিয়েছেন সিট ফাঁকা হওয়ায় এখন আমাকে তিনি নিতে পারবেন।
পাঠক আশা করি একটা বিষয় লক্ষ করেছেন, আর সব কলেজের মতোই ভিকারুননিসা কলেজও ছিল আমার মায়ের সরাসরি অধীনস্থ। হামিদা আপা খুব ভালো জানতেন এসএসসিতে আমার অতি ভালো ফলাফল সম্পর্কে। তিনি জানতেন আমি আমার মায়ের একমাত্র সন্তান। তারপরও তিনি তার দায়িত্ব পালন করে আমার মায়ের অনুরোধকে নাকচ করে দিয়েছিলেন। আমার মা-ও ন্যূনতম কোনও প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেননি। সিট খালি হয়েছে, তারপর আমি ভর্তি হতে পেরেছি। আজকের দিনে ভাবা যায় এই কথা?
হলিক্রস আর ভিকারুননিসার পরিবেশ সম্পূর্ণ আলাদা। হলিক্রস মিশনারি প্রতিষ্ঠান, ছাত্রী সংখ্যা সীমিত, নিয়ম-কানুন অতিমাত্রায় কড়া, শুধু পড়াশোনা না, একজন মানুষের জীবন গঠনে যা যা প্রয়োজন তার সবকিছুই হলিক্রস শিখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। অন্তত তখন পর্যন্ত তা-ই ছিল, এখন কী অবস্থা জানি না। সেই তুলনায় ভিকারুননিসায় ছাত্রী সংখ্যা অনেক বেশি, সবকিছুতেই হলিক্রসের তুলনায় একটা ঢিলেঢালা ভাব। একটা কথা জোর দিয়ে বলতে পারি, ১০ বছরে হলিক্রস আমাকে যেমন ঋণী করেছে, দেড় বছরের কলেজ জীবনে ভিকারুননিসা তার চেয়ে কম ঋণী করেনি। আমার জীবন গড়ে দিয়েছে এই দু’টি প্রতিষ্ঠান।
আজকে যখন ফেসবুকে ভিকারুননিসার অধ্যক্ষের অডিও ভাইরাল হলো, তখন তার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ, বাক্য, বাচনভঙ্গি আমাকে তীব্রভাবে আঘাত করেছে। কী নোংরা, কী ভীষণ নোংরা পুরো কথোপকথন। একটি জাতীয় দৈনিক তাদের কথোপকথনটির পুরোটা প্রকাশ করেছে। এই কথোপকথন এতটাই অশ্লীল যে পত্রিকাটিকে পুরো রিপোর্টে অসংখ্য ‘ডট’-এর ব্যবহার করতে হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের সাবেক ছাত্রী হিসেবে অনেকের চাইতে আঘাত আমাকে একটু বেশিই করেছে। আমার সময়ের অধ্যক্ষ হামিদা আলী, যিনি সারা দেশের মানুষের কাছে শ্রদ্ধার ও সম্মানের ব্যক্তিত্ব ছিলেন, তার সঙ্গে বর্তমান অধ্যক্ষের তুলনা করলে গোটা বাংলাদেশের অবক্ষয়ের একটা চিত্র স্পষ্ট হয়ে যায়।
কথোপকথনটিতে এটা স্পষ্ট তার বিরুদ্ধে কিছু মানুষ অভিযোগ করেছেন এবং সেটা তদন্তের জন্য কমিটি তৈরির চেষ্টা হয়েছে। কলামের আলোচনার খাতিরে ধরে নিলাম তার বিরুদ্ধে অন্যায় অভিযোগ করা হয়েছে। তো সেই সমস্যা সমাধান তিনি যেভাবে সমাধান করতে চেয়েছেন, সেটা দেখিয়ে দেয় ক্ষমতার দম্ভ এই দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কীভাবে প্রবেশ করেছে।
ওনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের উত্তর ওনার পিস্তল, যার দ্বারা কেউ তার পেছনে লাগলে তাকে তিনি কেবল প্রতিষ্ঠান না, দেশছাড়া করবেন এবং তার গোষ্ঠী উদ্ধার করবেন। তিনি আরও বলেন, ‘আর কোনও… বাচ্চা তদন্ত কমিটি করলে আমি কিন্তু দা দিয়ে কোপাবো তারে সোজা কথা’; ‘আমার … আছে। আমার বাহিনী আছে। আমার ছাত্রলীগ আছে, যুবলীগ আছে, আমার যুব মহিলা লীগ আছে। কিন্তু কিচ্ছু লাগবে না। কাপড় খুইলা রাস্তার মধ্যে পিটাব’; ‘আমি কিন্তু একদম, আমি কিন্তু গুলি করা মানুষ। রিভলবার নিয়া ব্যাগের মধ্যে হাঁটা মানুষ। আমার পিস্তল বালিশের নিচে থাকতো। সারা রাত পিস্তল আমার বালিশের নিচে থাকত।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি কোনও চিন্তা করি না। কারণ, আমি নিজেই শক্তিশালী। কোনও… কথায় আমি চলি না। কোনও… বাচ্চার কথায় আমি চলি না। আমি নিজেই কিন্তু শক্তিশালী। দলটার আমি প্রেসিডেন্ট ছিলাম। মনে রাইখেন এই দলটা এখন সরকারে। যতদিন এই দলটা আছে ততদিন আমার পাওয়ার আছে। আমি কিন্তু … বাচ্চাদের লেংটা করে রাস্তার মইধ্যে পিটাইতে পারবো। আমার লাগবে না, আমার দলের মেয়েদের ডাকলে দলের ছেলেও লাগবো না। মেয়েরাই ওর চুল-দাড়ি ছিঁইড়া প্যান্ট খুলে নামাইয়া দিবে’।
ওনার এই কথোপকথনটি অনেক বিষয় সামনে নিয়ে আসে।
১। যেকোনও নিয়োগে এখন অত্যাবশ্যকীয় যোগ্যতা ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচয়। শুধু দলীয় পরিচয় থাকলেই হবে না, তাকে ক্যাডার পালার যোগ্যতা এবং মানসিকতা থাকতে হবে। নিকট অতীতে ভিসিদের ক্ষেত্রেও আমরা তা-ই দেখেছি।
২। এই সরকার দীর্ঘকাল তার কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন চালানোর অবশ্যম্ভাবী ফল ফলেছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রতিটি স্তরে তৈরি হয়েছে ভীষণ রকম অসহনশীলতা। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধান চরম কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠছেন।
৩। কোনও পদধারীর বিরুদ্ধে কারও নিয়মতান্ত্রিক কোনও অভিযোগ করা এবং সেটার তদন্ত চাইবার অধিকার নেই সেই প্রতিষ্ঠানের কারও। একটা জবাবদিহিহীন সরকারের মানসিকতা ‘চুইয়ে পড়ে’ নীতিতে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিটি স্তরে।
৪। সরকার তার ক্ষমতার স্বার্থে ক্ষমতার সঙ্গে সরাসরি জড়িত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্রমাগত দুর্বল করেছে। কিন্তু আমরা এটা দেখলাম ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার সঙ্গে কোনও সরাসরি যোগসূত্র নেই এমন প্রতিষ্ঠানগুলো সরকার ভেঙে ফেলছে।
৫. ভিকারুননিসার ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। গত কয়েক বছরে সরকারি, আধাসরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নগ্ন দলীয়করণের মাধ্যমে ভেঙে ফেলার যে মহোৎসব চলছে, এটা তারই ধারাবাহিকতা মাত্র।
৬. কথোপকথনের একপর্যায় তিনি বলছিলেন ‘আমি রাজনীতি করা মেয়ে, আমি কিন্তু ভদ্র না’। আবার হুমকি দিচ্ছিলেন আগের রূপে ফিরে যাওয়ার। এই ক্লাসের বাইরে কি আর একজনও আওয়ামী-ভক্ত পাওয়া যায়নি যিনি যোগ্য? নাকি এই ক্লাসের হওয়াটাই একমাত্র যোগ্যতা? কথায় উঠে এসেছে উনি শিক্ষামন্ত্রীর ‘প্রিয় পাত্রী’। এই তাহলে তাদের প্রিয় হওয়ার মাপকাঠি!
৭. উনি বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার, ওনার চাকরি করার কথা কোনও সরকারি কলেজে। ওনাকে ভিকারুননিসায় দেওয়া হলো কেন? বাণিজ্যের সুযোগ ভালো?
আমি রাজনীতিতে আসি আমার বাবার মৃত্যুর পরে। উনি চেয়েছিলেন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করি। ওনার মতের বিরুদ্ধে যখন আইন পেশায় গেলাম, ওনার প্রত্যাশা ছিল আমি যেন অন্তত বিচারপতি হই। সেই সবকিছুর মুখে ছাই দিয়ে আজকে রাজনীতিকে জীবনের মূল লক্ষ্য করেছি দেখলে উনি কী ভাবতেন কে জানে। উনি যখন রাজনীতি করেছেন তখনও রাজনীতিতে এমন মাফিয়াতন্ত্র কায়েম হয়নি। সৎ, যোগ্য, মেধাবী বহু মানুষ তখনও রাজনীতিতে ছিলেন। মনে প্রশ্ন জাগে, আজ একজন কলেজের অধ্যক্ষের মুখে ‘আমি রাজনীতি করা মেয়ে, আমি কিন্তু ভদ্র না’ উক্তি শুনলে তিনি আমার রাজনীতি করাটাকে কীভাবে দেখতেন?
সামনের সময়টা ‘আই হেইট পলিটিক্স’ প্রজন্মের। একটা প্রজন্ম জন্মেছে, বেড়ে উঠেছে এবং প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে এই আবহে। রাজনীতির স্খলন শুরু হয়েছে তারও বেশ আগেই, যদিও এখনকার মতো এত সর্বনাশা ছিল না। আজ সমাজে রাজনীতি একটা ডেরোগেটরি শব্দ, আর রাজনীতিবিদরা ঘৃণ্য মানুষ। আশপাশে কান পাতলেই ফিসফিসানি শুনি – ভদ্রলোক কি রাজনীতি করে? কেউ সামনে কখনও ঠাট্টাচ্ছলে বলেও ফেলে। তখন এমন স্টেরিওটাইপ করার বিরুদ্ধে বড় গলায় প্রতিবাদ করি। এই প্রতিবাদের ‘বড় গলা’ কিছুটা ছোট তো হলোই। একজন রাজনীতি করা মানুষ কাউকে যাচ্ছেতাই হুমকি দেওয়ার জন্য নিজেকে ‘ভদ্র না’ প্রমাণ করতে হয় আর সেটার কারণ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন রাজনীতিকেই। জানি এই অধ্যক্ষের উক্তিটি সব রাজনীতিবিদের দিকেই যাবে ‘ভদ্রলোক কি রাজনীতি করে?’-এর প্রমাণ হিসেবে।
এ দিকে ভিকারুননিসা নূন কলেজের অধ্যক্ষের এই ঘটনাটি এখন সারা দেশের টক অব দ্যা টাউনে পরিনীত হয়েছে। যার ফলে নানা ধরনের সমালোচনা হচ্ছে। তবে এ নিয়ে এখনো মুখ খুলেনি শিক্ষা অধিদফতর।