বর্তমান ক্ষমতাসীন দলকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য বিএনপি দেশজুড়ে ধারাবাহিকভাবে সমাবেশ করছে, এই ধারাবাহিকতায় এবার সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলো রাজধানী ঢাকায়। গতকাল অর্থাৎ ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গোলাপবাগে বিএনপি’র আলোচিত সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এই সমাবেশে বিএনপি’র বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী যোগ দিয়ে সমাবেশ সফল করেন। এই সমাবেশে বিএনপি’র ৭ জন সংসদ সদস্য সংসদ থেকে পদত্যাগ করার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে এই সাতজনের একজন না হলেও গত সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সমর্থন নিয়ে এমপি হন রেজাউল করিম বাবলু ওরফে গোলবাগী।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর রেজাউল জিয়া পরিবারের আসন হিসেবে পরিচিত বগুড়া-৭ আসনে (শাজাহানপুর-গাবতলী) ট্রাক প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হন।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সালের সবকটি জাতীয় নির্বাচনে ওই আসনে জয়ী হন। দ”ণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি তিনি। পরে বিএনপির মনোনয়ন পান দলের গাবতলী উপজেলা শাখার মোর্শেদ মিল্টন।
কিন্তু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে তার পদত্যাগপত্র গৃহীত না হওয়ায় তার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়। এখানেও আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী ছিল না। মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টিকে আসনটি দিয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ স্বতন্ত্র প্রার্থী ফেরদৌস আরা খানের পক্ষে কাজ করে। তিনি তৎকালীন গাবতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আজম খানের স্ত্রী এবং পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি রাফি নেওয়াজ খানের শাশুড়ি।
এ অবস্থায় ভোটের একদিন আগে স্বতন্ত্র প্রার্থী রেজাউল করিমকে সমর্থন দেয় স্থানীয় বিএনপি। তিনি ট্রাক প্রতীক নিয়ে ১ লাখ ৯০ হাজার ২৯৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। কিন্তু সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে রেজাউল করিম বাবলুর সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই।
এ প্রসঙ্গে শাজাহানপুর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক খায়রুল বাশার বলেন, ‘২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আমরা কেন্দ্রীয় নির্দেশে মাঠপর্যায়ে রেজাউল করিম বাবলুকে সমর্থন দিয়েছিলাম। আমি তাকে ভোট দিয়েছি। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর তিনি আর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। আমরাও তার কাছে যাইনি।
পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে এমপি রেজাউল করিম বাবলু বলেন, ‘আমি কেন পদত্যাগ করব? আমি একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য। আমার পদত্যাগের কোনো কারণ নেই। পদত্যাগ করেছেন বিএনপির সংসদ সদস্যরা। এমন কথা শুনতে পাচ্ছি।
রেজাউল করিম বাবলু সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন সময় আলোচনা-সমালোচনার মুখে পড়েন। এ ছাড়া হলফনামায় তথ্য গোপন করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এমনকি সংসদ সদস্য হওয়ার দুই মাসের মধ্যে তার আর্থিক অবস্থারও পরিবর্তন হয়।
সর্বশেষ চলতি বছরের ২১ সেপ্টেম্বর শাজাহানপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দিকে পি”স্তল তাক করে শিরোনাম হন রেজাউল করিম। ওই দিন প্রকল্পের দেওয়া টাকা ফেরত দেওয়ার দাবিতে তার সঙ্গে উপজেলা যুবলীগ নেতার মধ্যে দ্ব”ন্দ্ব শুরু হয়। সংঘ”/র্ষ থামাতে গেলে এমপি উপজেলা চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন চান্নুর দিকে পি”/স্তল তাক করেন। পরে তিনি আত্মরক্ষার্থে পিস্ত”/লটি বের করেন বলে দাবি করেন।
নির্বাচন কমিশনের হলফনামা 3-এর ‘ক’ ধারায় বলা হয়েছে, প্রার্থীর বিরুদ্ধে অতীতে কোনো ফৌজদারি মামলা আছে কি না, থাকলে ফলাফল উল্লেখ করতে হবে। উল্লেখ্য, এ ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে আইন ও ধারায়। কোন থানায় মামলা হয়েছে। মামলা নম্বর এবং মামলার ফলাফল।
রেজাউল হলফনামায় দাবি করেন, তার বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা নেই। কিন্তু পরে তার বিরুদ্ধে মামলার প্রমাণ পাওয়া যায়। ২০০৭ সালে আবু হায়াত নামে এক ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। তার বাড়ি শাজাহানপুর উপজেলার গোয়ালগাছা গ্রামে।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, ২০০৭ সালে শাজাহানপুর উপজেলার মাঝিরা টেকনিক্যাল হাইস্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি থাকাকালে গোলবাগী চাকরি দেওয়ার নামে আবু হায়াতের কাছ থেকে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা নেন। কিন্তু শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাননি আবু হায়াত। টাকাও ফেরত পাননি তিনি।
মামলার বিষয়ে আবু হায়াত বলেন, এই বাবলু চাকরি দেওয়ার নামে অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। হলফনামায় মামলার তথ্য গোপনের বিষয়ে জানতে চাইলে সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বলেন, হলফনামায় তথ্য দিয়েছি কি না সে বিষয়ে কিছুই মনে নেই। কাগজপত্র দেখে বলতে পারি।
এদিকে সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় রেজাউল করিম বাবলু মাসিক আয় দেখিয়েছেন ৪১৭ টাকা। আয়ের উৎস বলা হয় কৃষি ও ব্যবসা। এর মধ্যে বছরে তিন হাজার টাকা আসে কৃষি থেকে। আর ব্যবসা থেকে বার্ষিক আয় দুই হাজার টাকা। নির্বাচনের আগে তার কাছে নগদ ৩০ হাজার টাকা ছিল। ব্যাংকে জমার পরিমাণও ৩০ হাজার টাকা। তার মোটর সাইকেলের মূল্য ৫০ হাজার টাকা বলে উল্লেখ করেন তিনি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সংসদ সদস্য হওয়ার আগে রেজাউল করিম বাবলুর কোনো ব্যবসা ছিল না। তিনি বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক বাংলা বুলেটিন নামে একটি পত্রিকার শাজাহানপুর উপজেলা প্রতিনিধি ছিলেন। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার দুই মাসের মধ্যে একটি গাড়ি (নোয়া হাইব্রিড) কিনে আলোচনায় আসেন।
বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে গত মার্চের শুরুতে দুদকের বগুড়া আঞ্চলিক কার্যালয় তার সম্পদের প্রাথমিক তথ্য চেয়ে নোটিশ পাঠায়। চিঠিতে, ১৪ মার্চ, ২০২১ এর আগে উপস্থিত হয়ে সম্পদের প্রাথমিক হিসাব জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
নোটিশের পর ১৪ মার্চ তিনি বগুড়ায় দুদক কার্যালয়ে যান। তবে ওই দিন তিনি কোনো তথ্য দেননি। রেকর্ড প্রস্তুত না থাকার অজুহাত দেখিয়ে সম্পদের হিসাব দাখিলের জন্য দুদকের কাছে সময় চেয়েছেন তিনি।
সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কাগজপত্র প্রমাণসহ আগামী তারিখে লিখিত জবাব দাখিল করব। দুদক কর্মকর্তারা আপাতত মৌখিকভাবে সময় দিয়েছেন।’ পরে সম্পদের বিবরণী দাখিলের জন্য তাকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত সময় দেয় দুদক। এরপর তিনি তার প্রাথমিক কাগজপত্র দুদকে জমা দেন।
এ বিষয়ে রেজাউল করিম বাবলু বলেন, শেষবার সাত দিন সময় নিয়ে সম্পদের হিসাব দিয়েছি। এরপর থেকে তার সম্পদের হিসাব যাচাইবাছাইয়ের কাজ ঝুলে আছে।
এদিকে তার সম্পদের হিসাব যাচাই-বাছাই করার জন্য এখনো দুদক তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান যিনি জেলা দুদক কার্যালয়ের উপ-পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত রয়েছেন, তার নিকট এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে, তিনি বলেন আমরা তদন্ত শুরু করার পর প্রাথমিকভাবে তার কিছু সম্পদের তথ্য পেয়েছি, সেগুলো বিভিন্নভাবে যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। আমরা খুব তাড়াতাড়ি তার সম্পদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দিতে পারব বলে আশা রাখি।