বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে অনেক অনেক অভিযোগ রয়েছে পুরো দেশ জুড়েই। দেশে এমন এমন সব ঘটনা রয়েছে যা মানুষকে হয়রান করে দেয় নাড়া দেয় মানুষের বিবেক বুদ্ধিকে। সম্প্রতি এমনি একটি ঘটনা ঘটেছে রাজধানীতে।মরিয়ম জামান আরফিয়া। আমাদের একমাত্র মেয়ে। বয়স আট বছর চার মাস। জ্বরের পর হাসপাতালে ভর্তি। পরামর্শ দিলে ভুল হবে। কারণ, খুব প্রয়োজন হলে আমার মেয়েকে আমাদের বাড়ির পাশের মালিবাগের যেকোনো হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারতাম। কিন্তু চিকিৎসক কোনোভাবে তাকে রেফার করা হাসপাতালে যেতে পীড়াপীড়ি করেন। পরে আমি আমার মেয়েকে সেখানে নিয়ে যাই। কিন্তু বাড়ি ফেরাতে পারিনি। আমার মেয়েকে জোর করে একের পর এক অন্যায় আচরণ করা হয়। তারা রোগ নির্ণয় করতে পারেনি। বরং ভর্তির পর থেকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যা চিকিৎসা করেছে তার সবই আমাদের অনুমতি ছাড়া।
এক সময় আমি আমার মেয়েকে জোরে জোরে কাঁদতে শুনছিলাম, আমাকে এক ফোঁটা জল দাও, আমাকে আমার বাবা-মায়ের কাছে যেতে দাও। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার অনুরোধে কর্ণপাত করেনি। উল্টো তারা আমার মেয়েকে হত্যার পর বলছে, আরফিয়া এখনো বেঁচে আছে। ইসিজি মেশিনে সমান্তরাল দাগ দেখা গেলে বলা হয় ত্রুটিপূর্ণ। পরে জানানো হয়, কয়েক ঘণ্টা আগে আমাদের একমাত্র সন্তান মারা গেছে।’- কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন মালিবাগের বাসিন্দা জুবাইদা আলম।
রাজধানীর শ্যামলীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি দুই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগও রয়েছে। একমাত্র মেয়ে মরিয়ম জামান আরফিয়াকে ডাঃ মোঃ মনিরুল ইসলাম ও ডাঃ ইসরাত জাহান লাকী ভুল চিকিৎসা করেছেন- জুবাইদা আলম ইতিমধ্যে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি), স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেছেন। শ্যামলীতে অবস্থিত বিশেষায়িত হাসপাতাল। এর পাশাপাশি তিনি রাজধানীর আদাবর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছেন।
তবে অভিযোগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন ঢাকা মেডিকেল কলেজের হেমাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোঃ মনিরুল ইসলাম। একইভাবে শ্যামলী ভিত্তিক বিশেষায়িত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, বিএমডিসি এবং স্বাস্থ্য বিভাগ অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য করতে প্রস্তুত নয়।
জুবাইদা আলম সারাবাংলাকে বলেন, “আমাদের একমাত্র মেয়ে আরফিয়ার জন্মের পর থেকে আমি তার সাথেই সর্বাধিক সময় কাটাতাম। জন্মের পর থ্যালাসেমিয়ার সমস্যা দেখা দিলে আমরা চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলে আসি। ২৯ জুন, ২০২১ তারিখে আমরা আরফিয়াকে আনোয়ার খানের কাছে নিয়ে যাই। আধুনিক হাসপাতালে।সেখানে তার রক্তশূন্যতা ধরা পড়ে।তার হিমোগ্লোবিন পাওয়া যায় ৯.২।ওই বছরের ১৭ জুলাই থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক মো.মনিরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে আমার মেয়ের চিকিৎসা চলতে থাকে।রক্তও দেওয়া হয়। তাকে তখন।
তিনি বলেন, ‘২০২১ সালের ডিসেম্বরে আমরা আমাদের মেয়েকে নিয়ে ভারতের ভেলোরের সিএমসি হাসপাতালে গিয়েছিলাম। কিন্তু রক্ত দেওয়ার বিষয়ে তারা কিছু বলেননি। আমরা দেশে এলে মনিরুল ইসলামকে জানান ডাঃ মো. এরপর থেকে প্রতি মাসে আমার আরফায়ারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা করানো হচ্ছিল। গত ৩০ আগস্ট ডাঃ মনিরুল বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে (২১, শ্যামলী, মিরপুর রোড ঢাকা) পরীক্ষা করে বলেন আরফির হিমোগ্লোবিন ৮.৭ এবং ফেরিটিন ১৫০। সেজন্য তিনি আগের ওষুধ চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। আমরা সেটা অনুসরণ করছিলাম।
গত ৭ সেপ্টেম্বর আরফিয়ার শরীরে জ্বর অনুভূত হলে জুবাইদা আলম বলেন, “থার্মোমিটারে তাপমাত্রা দেখে ভয় পেয়েছিলাম। ১০২ থেকে ১০৩ ডিগ্রি ওঠানামা করার বিষয়ে চিকিৎসককে জানান। ডাঃ মনিরুল ইসলাম দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেন। হাসপাতাল। জ্বরের জন্য কোন পরীক্ষা ছাড়াই হাসপাতালে ভর্তি করা হবে? বাড়িটি মালিবাগ হওয়ায় তাকে এখানে হাসপাতালে ভর্তি করা যাবে কি না, ডাক্তারের কাছে দুটি প্রশ্ন ছিল। তিনি বাংলাদেশ বিশেষায়িত হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি হতে বললেন। জোর করে আমরা আরফিয়াকেও ধরে নিই।কিন্তু তখনও জানতাম না আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে?’
তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য ওয়ার্ড থেকে নমুনা সংগ্রহ করে রোগ নির্ণয়ের জন্য পাঠানো হয়। কোনো ফল না পেলেও আরেক চিকিৎসক সেখানে এসে আরফিয়াকে স্যালাইন দিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে থাকেন। কিন্তু কেন একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছেন তা বলেননি। এ সময় এই চিকিৎসকের নাম জানতে পারলাম। ইসরাত জাহান লাকী। আজ বিকাল ৪টার দিকে ডাঃ মনিরুল এসে জানান আরফিয়ার টাইফয়েড হয়েছে। আর তাই অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে।
জুবাইদা বলেন, আমি অবাক হয়ে দেখলাম ভর্তির পরামর্শ দিলেও এরপর আর বেশি কথা বলেননি ড. মনিরুল। আর অন্যদিকে ইশরাতকে একের পর এক ইনজেকশন দিচ্ছিলেন ডা. তবে কেন দিচ্ছেন তা বলেননি। কিন্তু একটা সময় এসে তারা বলে যে আরফিয়ার ম্যালেরিয়া টেস্টের রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। একই সময়ে তার হিমোগ্লোবিন ৭.১ এ নেমে আসে। পরে আমাদের জানানো হয়, আরফিয়ার শারীরিক অবস্থা মোটামুটি ভালো। কারণ তার আর জ্বর নেই। এ কথা শুনে আমরা ডা. ইসরাত জাহান লাকীকে অনুরোধ করি যেন আমাকে আমার মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে যেতে দেয়। বললেন, তোমার মেয়ে ভালো আছে।
আফ্রিয়ার মা বলতে থাকলেন, “এর পর আমরা ডাঃ মনিরুলের সাথে যোগাযোগ করি। তিনি বললেন, আফ্রিকার জ্বর আবার আসবে। আর এবার ১০৫ থেকে ১০৬ ডিগ্রি হতে পারে। কিন্তু পরের দিন অর্থাৎ ৯ সেপ্টেম্বর সকালে আমাদের বলা হলো, আরফিয়ার বুকের ইনফেকশন।এই সময় আমি ওর বুক ও পিঠের এক্স-রে করতে বলি।তবে রিপোর্ট ভালো আছে বলে জানালেন।কিন্তু রাতে হঠাৎ করে এসে আরফিয়াকে আবার পিসিইউতে নিয়ে গেলেন।এবং এখান থেকেই আমার সব শেষ।
দুর্ভোগের বর্ণনা দিতে গিয়ে জুবাইদা বলেন, “ওরা আমার মেয়েকে পিআইসিইউতে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমার বা আমার স্বামীর কাছ থেকে কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। শুরু থেকেই আরফিয়াকে কেন সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো তা জানার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কেউ কিছু বলেনি। অনেক পরে। চেষ্টা করে, আমি পিআইসিইউ-তে ঢুকে দেখি আমার মেয়ে বিছানায় বসে আছে। আর সেখানে ডাক্তার ও নার্সরা আমার মেয়েকে উত্যক্ত করছে। তারা আমার মেয়েকে বলেছে যে তার বাবা ও মা বাড়ি চলে গেছেন। মেয়েটি আমাকে দেখে আমাকে নিয়ে যেতে বলল। তিনি বলেন, তারা আমাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছেন।এ সময় আমি সেখানে ডাক্তারসহ অন্যদের পা ধরে বললাম, টাকার প্রয়োজন হলে আমার কলিজা বাড়ি যেতে দিন।তারা কেউ আমার কথা শোনেনি। ওরা আমাকে সেখান থেকে বের করে দিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পিআইসিইউ’র বাইরে আমি অপেক্ষা করতে থাকি। তখন আমার মেয়ের বার বার চিৎকার ও আকুতি শুনতে পাচ্ছিলাম। আমার মেয়ে পানি খেতে চাইছিল। সে জোরে কান্না করছি এক ফোঁটা পানি হলেও যেনো ওকে দেওয়া হয়। আর আমি তখন বাইরে আকুল হয়ে ভেতরে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। রাতে একটা সময় দেখলাম আমার মেয়ের পরনের পোশাক ওয়ার্ড বয়ের কাছে। সে দৌড়ে পালিয়েছে আমাদের দেখে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের জানায় রক্ত লাগবে। আমি নিজেই ১০-১২ জন ডোনার নিয়ে এসে ক্রসম্যাচ করাই। কিন্তু তারা রক্ত নেনি।
জুবাইদা বলেন, ‘রাত ৪টার সময় মেয়ের শেষ চিৎকার শুনি আমি। ম্যানেজার এসে জানায় যে, আপনার মেয়েকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়েছে। এ সময় লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার জন্য কিছু কাগজে আমাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক সই নেয়। সকাল সাড় ৫ টায় মেয়ের কাছে গেলে সবাই আমাকে বলছিল, মেয়ের নাকি হার্টবিট চলছে। আমি চিকিৎসকের পায়ে ধরে বলি, সত্যি করে বলেন তো আমার মেয়ে কী বেঁচে আছে? তিনি আমার সঙ্গে রেগে বলে বেঁচে আছে। এ সময় আমাকে বলে আরফিয়াকে তিন দিন পর বেডে নিতে পারবেন। সাত দিন রাখলে ভালো হয়।’
তিনি বলেন, ‘আমি পরিষ্কার দেখছিলাম আমার মেয়ের হার্টবিট কাজ করছিল না। তখন আমার মেয়ে মরে গেছে বলে চিৎকার করে উঠি আর কিছুটা উত্তেজিত হই। কারণ ওরা আমার স্বামীকেও ভেতরে আসতে দিচ্ছিল না। এ সময় সেখানে থাকা তিন জন চিকিৎসক ও নার্স পালিয়ে যায়। তখন আমার সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। পরে আমার স্বামী ও আত্নীয় স্বজন চাপ দিলে তারা লাইফ সাপোর্ট খুলে দিতে বাধ্য হয়। মারা যাওয়ার প্রায় দুই ঘণ্টা পরে তারা আমার মেয়েকে মৃত ঘোষণা করে। আর ডেথ সনদে লিখে ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে নাকি মারা গেছে আমার মেয়ে। অথচ তারা এদ্দিন বলে এসেছে অন্য রোগের কথা।’
জুবাইদা বলেন, ‘ড. মনিরুল ইসলাম এবং ডাঃ ইসরাত জাহান লাকী আসলে কী চিকিৎসা করছেন তা আমাদের জানাননি। তারা কিছু না বুঝেই চিকিৎসা চালিয়ে যান। পরিকল্পিতভাবে আমার মেয়েকে সঠিক চিকিৎসা না দিয়ে ভুল চিকিৎসা দিয়ে হত্যা করেছে। আমি ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য বিভাগ ও বিএমডিসিতে অভিযোগ করেছি। থানায় সাধারণ ডায়েরিও করেছি। আমি বিশেষায়িত হাসপাতালেও অভিযোগ করেছি। এরপর আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে সমাধানের চেষ্টা করছেন।’ এখন আমি কি অন্য কোন সমাধান দিয়ে আমার মেয়েকে ফিরে পেতে পারি? আর তাই বিচার চাই- মরিয়ম জামান আরফিয়ার মা জুবাইদা আলম কাঁদতে থাকেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মনিরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, আমরা এ বিষয়ে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে লিখিত জবাব দেব। যা ওই হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমকে জানাবে।
এ দিকে এই ঘটনা নিয়ে যেন মুখ খুলতেই চাইছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষরা।তারা বিষয়টা একেবারেই এড়িয়ে যেতে চাইছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও সিইও আল ইমরান চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও অভিযোগের বিষয়ে তার কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। একইভাবে বিএমডিসির রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) ডা. লিয়াকত হোসেনের কাছ থেকেও অভিযোগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য জানতে পারেনি এই প্রতিবেদক।