মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী। আর এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে মানুষের একটাই নির্দিষ্ট বিষয় রয়েছে আর তা হলো মৃত্যু। মৃত্যুকে এড়িয়ে যাওয়া কোন ভাবেই সম্ভব না। তেমন একটি বিষয় নিয়েই স্মৃতিচারণ করে একটি লেখনি লিখেছেন আলোচিত ব্যক্তিত্ব পিনাকী ভট্টাচার্য।পাঠকদের উদ্দেশ্যে তার সেই লেখনি তুলে ধরা হলো হুবহু:-
আমরা যখন ডাক্তারি করা শুরু করি সেইসময়ে খুব বেশী এন্টিবায়োটিক ছিলোনা। আমি তখন ইন্টার্নশিপ করছি মেডিসিনে। রাজশাহীর সাপ্লাইয়ের পানি কোনভাবে টাইফয়েডের জীবানুতে ইনফেক্টেড হয়ে গেছিলো মনে হয়। এডমিশন ডে তে আমরা শুধু টাইফয়েড রোগী পেতাম। এর মধ্যে কারো কারো এতো মারাত্মক হতো টাইফয়েড যে অন্ত্র অনেক ফুটো হয়ে অন্ত্রের আধা হজম খাবার বের হয়ে যেতো অন্ত্র থেকে। জটিল টাইফয়েডে টাইফয়েড জীবাণু অন্ত্র ফুটো করে দেয়। আজকের ডাক্তারেরা সেই টাউফয়েড পারফোরেশন দেখেন না। কারণ অনেক ভালো ভালো এন্টিবায়োটিক এসেছে।
আমরা ক্লোরামফেনিকল দিতাম ক্লোরামফেনিকল রেজিস্ট্যান্ট হলে এমোক্সিসিলিন দুই গ্রাম করে তিনবার দিতাম। ভালো হয়ে যেতো বেশীরভাগ রোগীই তবে অন্ত্র যাদের ফুটো হয়ে যেতো তাদের বাচানো মুশকিল হয়ে যেতো। তীব্র যন্ত্রণায় রোগীরা ছটফট করতো। কারো কারো পেটের কালেকশন সুচ ফুটিয়ে টেনে বের করে এনে রিলিফ দেয়ার চেষ্টা করতাম আমরা।
এর মধ্যে একদিন একজন তরুণ মাদ্রাসা শিক্ষক ভর্তি হলেন টাইফয়েড নিয়ে। চিকিৎসা শুরু করতে না করতেই পারফোরেশনের উপসর্গ দেখা গেলো। প্রচুর কালেকশন হলো পেটের ভেতরে। আমারই দায়িত্ব পড়লো প্রত্যেকদিন সিরিঞ্জ দিয়ে টেনে টেনে যতটুকু পারা যায় কালেকশন বের করে ফেলার। কালেকশন বের করে ফেললে রোগী বেশ আরাম পেতো, আরামে আর আবেগে বলে উঠতো, আহ বেহেস্ত বেহেস্ত।
আমি খুব সকালে উঠে রোগীর কাছে যেতাম যত তাড়াতাড়ি তাকে রিলিফ দেয়া যায় এই আশায়। দিনে একবার কালেকশন বের করে দিলেই চলতো। রোগী আমার আসার অপেক্ষায় তৃষিতের মতো অপেক্ষা করতো। আমিও কাজটা খুব নিষ্ঠার সাথে করতাম। কিন্তু সবকিছু তো মানুষের হাতে থাকেনা। রোগী ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যাচ্ছিলো বুঝতে পারছিলাম। একদিন সকালে গিয়ে দেখি বিছানা ফাকা, স্টাফ নার্স নিজেই বিছানা গোছাচ্ছেন। ধীরে ধীরে বিছানার কাছে গিয়ে দাড়ালাম। জিজ্ঞেস করলাম, কখন? স্টাফ নার্স বললেন রাতে ঘুমের মধ্যেই। আমার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়তে থাকলো। কানে ভেসে আসতে থাকলো সেই আওয়াজ, আহ বেহেস্ত বেহেস্ত। স্টাফ নার্স অনেক বয়স্কা ছিলেন, প্রায় আমার মায়ের বয়সি। পাশে এসে কাধে হাত দিয়ে বললেন, ডাক্তার হয়েছেন, এমন মৃত্যু প্রত্যেকদিন দেখবেন, এভাবে কান্নাকাটি করলে ডাক্তারি করবেন কীভাবে? ভেবে দেখেন আপনার রোগী কী ভয়ানক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছে।
আমি তখন ঘোরতর নাস্তিক তবুও আমার ভাবতে ভালো লাগলো আমার রোগী সেই অনন্ত শান্তির বেহেস্তে শুভ্র পোশাকে এক দারুণ বাগানে প্রজাপতির মতো উড়ছে আর বলছে, আহ, বেহেস্ত বেহেস্ত।
প্রসঙ্গত, পিনাকী ভট্টাচার্য বর্তমানে প্রবাস জীবন যাপন করছেন। একটা সময়ে তিনি ছিলেন বাংলাদেশে। লেখালিখর জন্য তিনি বেশ জনপ্রিয়। বর্তমানে তিনি বিদেশে থাকলেও দেশের নানা ধরনের সব সাময়িক বিষয় নিয়ে সব সময়ই কথা বলে থাকেন লেখালেখি করে থাকেন স্যোশাল মিডিয়ায়।