সারা দেশে এখন একটা ঘটনাই টক অব দ্যা টাউনে পরিনীত হয়েছে গতকাল রাজধানীতে ঘটে যাওয়া ঘটনা। আর এই ঘটনায় এখন সবখানেই শুরু হয়েছে আলোচনা আর শোক। গতকাল এ ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিল প্রতক্ষ্যেদর্শী এক যুবক।
দুপুর পর্যন্ত কাজ শেষ করে বিল্ডিংয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা বিকট শব্দ শুনতে পেলাম। রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি বাম পাশে একটা বাস। তার পাশেই একটি প্রাইভেট কার গার্ডার দিয়ে ঢাকা। আরও কয়েকজন একসঙ্গে দৌড়ে গেল। গাড়ির কাছে যেতেই ভেতরে লোকজনের আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি হাতে যে রড-বেলচা পেয়েছি তা দিয়ে গার্ডারটি সরানোর চেষ্টা করছিলাম। গাড়ির সামনে থেকে একজন লোক বেরিয়ে আসে। তার মাথা থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। দরজা ভেঙে এক মহিলাকেও উদ্ধার করি। তখন দেখলাম একটি শিশু তার হাত পা নাড়াচ্ছে। কিন্তু আমরা এটা বের করার সামর্থ্য নেই। আমরা যদি গার্ডারটি সরাতে পারতাম তবে আমরা এটিকে বাঁচাতে পারতাম। কিন্তু রড-শাটল দিয়ে গার্ডার সরে না। শিশুটিকেও বাঁচাতে পারিনি।
সোমবার (১৫ আগস্ট) সন্ধ্যায় সারাবাংলা প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন ইমরান হোসেন। উত্তরায় বিআরটি প্রকল্পের ফ্লাইওভারের গার্ডার চেপে প্রাইভেটকারের ভেতরে থাকা যাত্রীদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেন তিনি। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ছুটে যাওয়ার পাশাপাশি তিনি স্থানীয়দের সঙ্গে গাড়ির যাত্রীদের উদ্ধারের চেষ্টা করেন।
রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করা ইমরান সারাবাংলাকে বলেন, “গার্ডারটা যখন ওঠানো হচ্ছে তখন দেখলাম। শুনেছি গাড়িতে তোলা হবে। ভাত খেয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পেলাম। রাস্তায় নেমে, আমি প্রথমে ভেবেছিলাম যে হয়তো একটি গাড়ি অন্যটিকে হত্যা করেছে৷ আমি যে বিল্ডিংয়ে কাজ করি তার সামনের দিকে তাকালে আমি প্রাইভেট কারগুলির উপরে গার্ডারগুলি দেখতে পাই৷ তার পিছনে একটি বাস ব্রেক চেপে বাঁ দিকে যাচ্ছিল৷ পালা
তিনি বলেন, “আশেপাশের লোকজন ছুটে এলেও গার্ড সরানোর মতো কিছু ছিল না। আমরা কয়েকজন রড-শ্যাম্বল হাতের কাছে যেটুকু পাচ্ছি তা দিয়ে গার্ডার সরানোর চেষ্টা করছিলাম। আর কেউ ছিল না। আমি গিয়েছিলাম। গাড়ির পাশ দিয়ে দেখলাম গার্ডার না উঠলে কাউকে বের করা যাবে না।
তিনি আরও বলেন, আমরাও চেষ্টা করি ভিতর থেকে মানুষকে বের করে আনার। আমরা তাদের কণ্ঠস্বর শুনছিলাম। এমন সময় একজন ফাটা মাথা নিয়ে বেরিয়ে আসে। কিন্তু পেছনের সিটে থাকা যাত্রীদের বের করা সম্ভব হচ্ছে না।
ইমরান বলেন, “তারপর আমরা দরজা ভেঙে দেই। সেখান থেকে একজন মহিলাকে বের করে নিয়ে ভিতরে তাকাই। তখন সেখানে একটি শিশু তার হাত-পা নাড়ছিল। কিন্তু গার্ডারটি এমনভাবে পড়ে গিয়েছিল যে আমরা তাকে বের করতে পারিনি। কিন্তু এটি রড, লাঠি ও শাবল দিয়ে গার্ডার সরানো সম্ভব নয়।গার্ডারটি দ্রুত সরানো গেলে শিশুটিকে বাঁচানো যেত বলে মন্তব্য করেন ইমরান।
তিনি বলেন, ‘আমি যে মহিলাকে গাড়ি থেকে নামিয়েছি, তিনি জোরে কাঁদছিলেন। সে সময় তাকে বের করার জন্য আমরা নানাভাবে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তা আর সম্ভব নয়। এর কিছুক্ষণ পর ফায়ার সার্ভিসের লোকজন উদ্ধার কাজে যোগ দেন। ততক্ষণে শিশুটি আর বেঁচে নেই।
এর আগে, সোমবার (১৫ আগস্ট) বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে রাজধানীর উত্তরার জসিমউদ্দিন মোড় সংলগ্ন সড়কে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) নির্মাণ প্রকল্পের একটি প্রাইভেটকারের রেললাইন ছিটকে পড়ে। এতে পাঁচ যাত্রী নিহত হন। আহত হয়েছেন আরও দুই যাত্রী। প্রাইভেটকারটি গার্ডারের নিচে চাপা পড়ে থাকায় তাৎক্ষণিক উদ্ধার কাজ স্থানীয়দের পক্ষে সম্ভব হয়নি। পরে এক্সকাভেটর দিয়ে গার্ডার সরিয়ে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
দুর্ঘটনার শিকার প্রাইভেটকারে একই পরিবারের সাত সদস্য ছিলেন। নিহতরা হলেন রুবেল (৬০), ফাহিমা (৪০), ঝর্ণা (২৮), ঝর্ণার দুই সন্তান জান্নাত (৬) ও জাকারিয়া (২)। ঘটনাস্থলেই তাদের মৃত্যু হয়।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত শনিবার হৃদয় ও রিয়া বিয়ে করেন। তারা আজ ছেলের বাড়ি থেকে মেয়ের বাড়ি যাচ্ছিল। হৃদয়ের পরিবার দক্ষিণখান থানার কাওলা আফিল মেম্বারের বাড়ির ভাড়াটিয়া। আর কনে রিয়া মনির বাড়ি আশুলিয়ার খেজুর বাগানে আসরাফুদ্দিন চেয়ারম্যানের বাড়ি এলাকায়। গাড়িতে হৃদিয়া ও রিয়া মনি থাকলেও সেখান থেকে তাদের উদ্ধার করে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
এ দিকে এই ঘটনার সাথে জড়িত সকলকে আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সাথে এই সব প্রতিষ্ঠান গুলোকে কালো তালিকায় আনার কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সেই সাথে ঐ কাজও বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন উত্তেরর মেয়র।