বিএনপি দেশজুড়ে বিভাগীয় শহরগুলোতে গনসমাবেশ কারার পর দলের নেতাকর্মীরা অনেকটা জেগে উঠেছিল। তবে সেই জেগে ওঠার পর বর্তমান সময়ে বিএনপির সেই নেতাকর্মীরাই কিছুটা স্তিমিত হয়ে গেছেন। তবে এই বিষয়টিকে দলের শীর্ষ নেতারা গুরুত্ব দিলেও তেমন কিছু করে উঠতে পারছেন না তারা। তবে তারা আন্দোলনকে গুরুত্ব দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে চান। তবে এরই মধ্যে দলের এক শীর্ষ নেতাকে নিয়ে কিছুটা চিন্তিত নেতারা। আর তিনি হলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানুল্লাহ আমান।
‘১০ ডিসেম্বরের পর খালেদা জিয়ার কথায় দেশ চলবে’- আমানুল্লাহ আমানের বক্তব্য নিয়ে এখনো আলোচনা-সমালোচনা থেমে নেই। আমানের ‘অপরিপক্ক’ বক্তব্যের খেসারত দলকে দিতে হবে বলে মনে করছেন বিএনপি নেতারা।
গত ১০ ডিসেম্বর তার বক্তব্যের পর বিএনপির কর্মসূচিকে ঘিরে ক্ষমতাসীন দল বিরোধী দলের ওপর চড়াও হয়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসসহ সিনিয়র নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়। ১০ ডিসেম্বর স্বাভাবিক কর্মসূচি পালন করা হবে, বিএনপির পক্ষ থেকে বারবার বলা হলেও সরকার তা বিশ্বাস করেনি। আন্দোলন দমন নামে প্রশাসন, আন্দোলন স্তিমিত হয়।
আমানউল্লাহ আমানের বক্তব্য ও সাম্প্রতিক ভূমিকা বিএনপিতে কিছুটা অস্বস্তি সৃষ্টি করছে। তাকে মহানগর কমিটিতে না রাখার বিষয়েও মত দিয়েছেন অনেকে।
গত বৃহস্পতিবার স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলের অভ্যন্তরীণ নানা সমস্যা ও সংশয় নিয়ে আলোচনা হয়। এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমানকে নিয়ে। বৈঠকে গুলশান কার্যালয়ে ১৫টি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ও আন্দোলন নিয়ে ‘বিতর্কিত’ বক্তব্যের পেছনে তার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন স্থায়ী কমিটির নেতারা। এছাড়া নয়াপল্টনে চার শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হলেও প্রথমে আমানের জামিন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তারা।
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নেতারা বলেন, ক্ষমতাসীন দলের নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও গত কয়েক মাসে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে সফল হয়েছে বিএনপি। এতে সারাদেশের নেতা-কর্মী ও সাধারণ সমর্থকদের মধ্যে চূড়ান্ত আন্দোলনের মানসিকতা তৈরি হয়েছে। তৃণমূলের নেতা-কর্মীরাও বিগত দিনের মতো চূড়ান্ত আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু ১০ ডিসেম্বর গোলাপবাগে বিভাগীয় গণসমাবেশ এবং ১১ জানুয়ারি গণঅবস্থান কর্মসূচির জন্য ঢাকার প্রস্তুতি সফল হয়নি। বৈঠকে আগামী দিনে কী কর্মসূচি নেওয়া যেতে পারে সে বিষয়টিও উঠে আসে। নেতারা সরকার পতনের জন্য চূড়ান্ত আন্দোলনের জন্য ঢাকাকে প্রস্তুত করতে সম্মত হন। বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে একাধিকবার ফোন করেও আমানুল্লাহ আমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। এ ছাড়া স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলা হলেও তারা কথা বলতে রাজি হননি।
সূত্র জানায়, বৈঠকে ১০ ডিসেম্বর জনসভার আগে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমানসহ একাধিক নেতার বক্তব্য নিয়ে আলোচনা হয়। এক অনুষ্ঠানে আমান বলেন, ১০ ডিসেম্বরের পর খালেদা জিয়ার কথায় দেশ চলবে। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, ওই ভাষণের পর সরকার ভী”ত হয়ে পড়ে। তবে এই ভাষণের পর আমান উল্লাহকে হুঁশি”য়ারি দেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
আবারও বিষয়টি উঠে আসে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে। বৈঠকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উদ্দেশে এক নেতা বলেন, গ্রেফতার হয়েছি কিনা তখনও জানতাম না। কিন্তু ডিবি কার্যালয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, গল্পের ছলে জানতে চাওয়া হয়, আমরা বসে যাব কিনা? যতবারই বলেছি, তাদের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেই। থাকলে আমি জানতাম। অন্যান্য বিভাগীয় গণসমাবেশের মতোই এটা একটি গণসমাবেশ। কিন্তু ডিবি পুলিশ কোনো অবস্থায় তা বিশ্বাস করতে চায়নি।
ওই নেতা বলেন, আমি ইলিয়াস আলীর নিখোঁজের বিষয়ে মিথ্যা বক্তব্য দিয়েছিলাম, সে ঘটনায় আমার কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছিল। তাহলে আমানের কাছে কেন ব্যাখ্যা চাওয়া হবে না? এরপর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাধারণ সম্পাদককে বিষয়টি দেখতে বলেন। বৈঠকে এই নেতা আরও বলেন, সরকারের লোকজনকে নিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন করা যাবে না। যার ভিত্তিতে সবাইকে গ্রেফতার করা হয়েছিল তিনি আবার জেলে যাওয়ার আগেই মুক্তি পেয়েছিলেন। এ নিয়ে সাধারণ নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এটা পরিষ্কার হওয়া দরকার।
সূত্র জানায়, স্থায়ী কমিটির এই বৈঠকের আগে বুধবার নয়াপল্টনে জনসমাবেশ কর্মসূচিতে সভাপতিত্ব করেননি ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান। আগের দিন বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, অন্যদের সঙ্গে গণস্থান কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেবেন আমানউল্লাহ আমান। এরপর থেকে গু”জব ছড়ানো হচ্ছে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় তা আরও জোরালো হয়, জনসভায় ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির নেতাকর্মীদের উপস্থিতি দেখতে চান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সে অনুযায়ী বিশেষ অতিথি হিসেবে মির্জা আব্বাস যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন দলের কেন্দ্রীয় একজন নেতা লাইভে বিস্তারিত দেখান। এ সময় ঢাকা মহানগর উত্তরের নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ছিল খুবই কম।
সূত্র আরও জানায়, ১৫টি সংগঠনের সঙ্গে জোট করেছে কারা? স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও এ প্রশ্ন উঠেছে। গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ২০ দলীয় জোট ভেঙে ১৫টি সংগঠনের সঙ্গে জোট গঠন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে স্থায়ী কমিটির এক নেতা জানতে চাইলেন, এটা কীভাবে হলো, আবার গুলশান কার্যালয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবমুখী ১৫ সংগঠন নিয়ে একটি জোট গঠন করলাম-এটা কেমন বার্তা গেল? এ সময় স্থায়ী কমিটির আরেক নেতা বলেন, একটি বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার। গুলশান কার্যালয়ে ছোট ছোট দল নিয়ে জোট গঠন করা হয়েছে। আসলে এগুলো রাজনৈতিক দল নয়। এ কারণেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ৫৪ দলের ৫৪টি ঘোড়ার ডিম পাড়ার মতো মন্তব্য করার সুযোগ পান। কারা করছে, কিভাবে করছে? এটা বিহিত করা প্রয়োজন. এই জোটের সূচনা অনুষ্ঠানে স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু উপস্থিত থাকলেও তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে চান না। আমান উল্লাহ আমানের তত্ত্বাবধানে এটা হয়েছে। এক নেতা জানতে চান, আমানকে দলের কর্তৃত্ব কে দিয়েছে? এ সময় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আরও বলেন, এই জোট গঠনের বিষয়ে তাকেও জানানো হয়নি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা ও ভাইস চেয়ারম্যান দেশের একটি জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ঢাকা মহানগরের সমস্যা সমাধানে এবং দলের সন্দেহভাজন নেতাদের দূরে রাখতে আন্দোলনের পরিকল্পনা করলেই সফলতা আসবে। ২০১৪ সালের আন্দোলন ঢাকার নেতাদের জন্য ব্যর্থ হয়েছিল। এবার সেই ঢাকাকে ঠিক করেই আন্দোলনে যেতে হবে।
প্রসংগত, বিএনপির শীর্ষ নেতারা গ্রেফতারের পর থেকে দলের আন্দোলনের গতি কিছুটা দমে গেছে। এই কারনটি হলো দলের নেতাদের যে কোনো মুহুর্তে গ্রেফতার ভীতি। এর আগে দলের দুই শীর্ষ নেতা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও মির্জা আব্বাস গ্রেফতার হওয়ার পর ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ তেমন আশাব্যঞ্জক হয়নি। এদিকে বিএনপির হাতে দুটি অপশন রয়েছে- একটি হলো আন্দোলন জোরালো করা এবং অন্যটি হলো বিদেশের হস্তক্ষেপ সৃষ্টি করা। অবশ্য এই দুইটা পথ অবলম্বন করার চেষ্টা চালাচ্ছে দলটি।