বর্তমান সময়ে মার্কিন নিষেজ্ঞাকে ঘিরে এক অস্থিতিশীল পরিবেশের মধ্যে পতিত হয়েছে বাংলাদেশ। এমনকি নানা ভাবে প্রশ্ন বিদ্ধ হয়েছে দেশ জুড়ে। এমনকি বিশ্ব পরিমন্ডলেও বাংলাদেশের এই ঘটনাকে ঘিরে দেশের গনতন্ত্র নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে। তবে এই পরিস্তিতি মোকাবিলার জন্য নিরলস ভাবে কাজ করছে বাংলাদেশ সরকার। এছাড়াও কোন কোন দেশ বাংলাদেশের উপর কী কারনে অসুন্তষ্ট এই বিষয় শনাক্ত করে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহনের লক্ষ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তিরা। সম্প্রতি বাংলাদেশকে ঘিরে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ প্রসঙ্গে বেশ কিছু কথা তুলে ধরলেন বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
ভার্চ্যুয়াল দূত সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রতি ইঙ্গিত করে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে তৎপরতা বাড়ানোর জোর তাগিদ দিয়েছেন। মন্ত্রী নিষেধাজ্ঞা শব্দটি মুখে না নিয়েই বলেন, “ইদানীংকালে আমাদের কিছু বিষয়ে ‘ঝামেলা’ হচ্ছে। কিছু প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে অভিযোগ এসেছে। এগুলো বানোয়াট, এসবের কোনো ভিত্তি নেই। আমি আপনাদের অনুরোধ করবো, যেখানে যেভাবে দরকার সেভাবে সত্য তথ্যটা তুলে ধরুন।” বৃহস্পতিবার ঢাকার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত পৌনে ৯টা অবধি পৌনে ৩ ঘণ্টার ওই সম্মেলনে মন্ত্রী দেশের ভাবমূর্তি সমুজ্জ্বল করতেই ৮১ মিশন প্রধানের প্রতি দফায় দফায় নির্দেশনা দেন। মন্ত্রীর উদ্বোধনী এবং সমাপনী বক্তৃতার পুরো অংশজুড়েই ছিল ইকোনমিক এবং পাবলিক ডিপ্লোমেসিকে প্রমোট করা, বঙ্গবন্ধুর ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন একযুগ বয়সী সরকারের উন্নয়নের ব্যাপক প্রচারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রতি বিদেশিদের আকৃষ্টকরণে উদ্যোগ গ্রহণের নির্দেশনা। অনুষ্ঠানে উপস্থিত পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপি সুনির্দিষ্টভাবে রো/হি/ঙ্গা সংকটের সমাধান এবং জেনোসাইড ডে’র স্বীকৃতি আদায়ে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন পেতে তৎপরতা জোরদারের আহ্বান জানান।
তিনি ২০২২ সালের কার্যক্রমের মিশন ওয়ারি পরিকল্পনা চেয়েছেন। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, অন্তত ৮ জন রাষ্ট্রদূত উন্মুক্ত সেশনে তাদের মতামত খোলাখুলিভাবে তুলে ধরেন। তবে বেশিরভাগ মিশন প্রধানের নীরবতা ছিল রহস্যজনক। তাদের অনেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সরকারের বর্তমান মেয়াদের ৩ বছরপূর্তিতে লিখিত অভিনন্দন বার্তা পাঠানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছেন। অনুষ্ঠানে মন্ত্রী কনস্যুলার সেবাদানকারী বেশিরভাগ মিশনের বিরুদ্ধে বিদ্যমান অভিযোগগুলোর বিস্তারিত তুলে ধরেন। একইসঙ্গে এসবের আশু নিষ্পত্তি কামনা করেন। মিশনগুলোতে পাসপোর্ট পেতে যে সীমাহীন ভোগান্তি চলছে তার খ-চিত্র মিশন প্রধানরা তুলে ধরেন। সৌদিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী অঞ্চলভিত্তিক দূত সম্মেলন অনুষ্ঠানের অনুরোধ করেন। অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া ও ইতালির নাম নিয়ে বলেন, ওই সব এলাকায় দালাল চক্র আছে এমন অভিযোগের কথা আমরা প্রায়ই শুনি। দালাল চক্র অনেক জায়গাতে খুবই শক্তিশালী। মন্ত্রী বলেন, দেশে দেশে স্থানীয় মিডিয়াকর্মীদের (প্রবাসী) সঙ্গে দালাল চক্রের একটা খাতির আছে। আপনি যদি শক্ত হন তখন তারা (দালালরা) মিডিয়াকে ব্যবহার করে মিশনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম রিপোর্ট করাবে। এমন কিছু নিদর্শন মন্ত্রী পেয়েছেন দাবি করে বলেন, মিশন প্রধান শক্ত অবস্থান নেয়ার কারণে দালাল চক্র মিডিয়াকে ব্যবহার করে অপপ্রচার করেছে এমন প্রমাণ পেয়েছি। কিন্তু আমি আপনাদের কথা দিতে চাই, আপনি যদি কর্তব্যপরায়ণ হন, সৎ হন তাহলে মন্ত্রণালয় যত রকম সাপোর্ট দরকার আপনাকে দিবে। কিন্তু আপনাকে সৎ ও কর্তব্যপরায়ণ হতে হবে। আর এটি হলে দালাল চক্র ভাঙা সম্ভব হবে। মন্ত্রী বলেন, আপনাদের সঙ্গে যারা টিম ওয়ার্ক করেন বিভিন্ন লেভেলের কর্মচারীরা আছেন- তারা দায়সারা কাজ করেন। ফলে আপনাদের (মিশন প্রধানদের) বদনাম হয়। দায়সারা কাজ সহ্য করবেন না। সময় সময় তাদেরকে নির্দেশনা দিবেন। মন্ত্রী বলেন, অভিযোগ আছে মিশনগুলোতে বারবার ফোন করেও কাউকে পাওয়া যায় না। আমি এজন্য ৭ দিন ২৪ ঘণ্টা হট লাইন চালু রাখার প্রস্তাব করেছিলাম। প্রয়োজনে আমরা আউটসোর্সিং করবো। আমরা এজন্য দরকার হলে পে করবো।
মিশনে যারা ফোন করেন তারা গল্প করার জন্য নয় বরং নিতান্ত প্রয়োজনেই ফোন করেন জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, সুতরাং হটলাইন থাকলে তিনি (সেবাপ্রার্থী) অন্তত একটা রেসপন্স পাবেন। ফলে তিনি কমফোর্ট ফিল করবেন। বিদেশে বাংলাদেশের কোনো মিশনের বদনাম শুনতে চান না- এমন স্পষ্ট উচ্চারণে মন্ত্রী বলেন, প্রবাসীদের আপনারা হাসিমুখে সেবা দিন। কেউ যেন আমাদের বদনাম না করে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে আপনারা কাজ করুন। একই সঙ্গে কীভাবে বিদেশে কর্মসংস্থান বাড়ানো যায়, সেদিকে আপনারা দৃষ্টি দিন। প্রবাসের জেলে কোনো বাংলাদেশি থাকলে, তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নিন। একই সঙ্গে মিশনগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন। বিশ্বের বড় বড় দেশ তাদের নিজ দেশের ব্যবসা বাড়ানোর জন্য রাষ্ট্রদূতদের বিশেষভাবে কাজে লাগায় জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, তারা পারলে আমরা কেন পারবো না? আমি আপনাদের অনুরোধ করবো আপনারা এ বিষয়ে বিশেষ উদ্যোগ নেন। আমরা দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীদের এ ক্ষেত্রে সাহায্য সহযোগিতা করবো। আমরা চাই বাংলাদেশি পণ্যের উৎপাদনে ডাইভারসিটি আসুক। এ বিষয়ে আপনাদের সহযোগিতা একান্তভাবে চাই আমি। বাংলাদেশি শ্রমিকদের কাজে লাগাতে নতুন ক্ষেত্র সন্ধান করার তাগিদ দিয়ে মন্ত্রী বলেন, আফ্রিকায় জমি লিজ নিয়ে চাষ করতে হবে, এ জন্য রাষ্ট্রদূতদের এগিয়ে আসতে হবে।
বঙ্গবন্ধু বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মহান কূটনীতিক ছিলেন উল্লেখ করে মোমেন বলেন, বঙ্গবন্ধু তার কূটনৈতিক দূরদর্শিতা থেকেই আমাদের পররাষ্ট্রনীতি প্রবর্তন করেছিলেন- ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বৈরিতা নয়।’ বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশের সব দূতাবাসে হাসিমুখে সেবা দিতে বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী যেন সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে কোনো ধরনের দুর্ব্যবহার না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে মিশন প্রধানদের সতর্ক করে মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের সব দূতাবাসে সেবার গুণগত মান বাড়ান। বুধবারও বিদেশে বাংলাদেশের একটি মিশন সম্পর্কে বড় অভিযোগ পেয়েছেন দাবি করে মন্ত্রী বলেন, আমাদের একটি মিশনে একজন গিয়েছিলেন, যার পরনে অন্য ধরনের কাপড় ছিল, সাধুর কাপড়। সেজন্য তাকে মিশনে ঢুকতে দেয়া হয়নি। আমি ঠিক জানি না, এ বিষয়ে আমাদের কোনো পলিসি আছে কিনা? মিশনে ঢুকতে গেলে নির্দিষ্ট কোনো ড্রেসকোড আছে কিনা? আমি জানি না। যারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন তারা বলতে পারেন। দেশে কিন্তু এমনটা নেই, ড্রেসকোড নেই। আমার অফিসে যে কেউ যেকোনো ধরনের পোশাক পরে আসতে পারেন। মন্ত্রী বলেন, এটা খুব সিরিয়াস বিষয় যে একজন সেবাপ্রার্থীকে ড্রেসকোডের জন্য মিশনে ঢুকতে দেয়া হলো না! মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে বাংলাদেশিদের কা/রা/গা/রে থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, আমি জেনেছি ভারতীয় বন্দি সেই দেশের দূতাবাসের কর্মকর্তা ছাড়িয়ে নিয়ে যান, কিন্তু বাংলাদেশের কেউ কারাগারে যান না। এটি আমার শুনতে ভালো লাগে না। ট্রাভেল ডকুমেন্ট জোগাড় করে তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করুন। দরকার হলে আইনি সহায়তা প্রদান করুন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষ থেকে ভার্চ্যুয়াল প্লাটফরমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে মন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন যুক্ত হয়েছিলেন। আর বিদেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা যুক্ত হয়েছিলেন নিজ নিজ অফিস থেকে। ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে দূত সম্মেলনের সূচনা হয়। সেখানে মন্ত্রী তাদের দায়িত্ব পালনে বছরের শুরুতেই ‘কড়া নির্দেশনা’ প্রদানের জন্য দুঃখও প্রকাশ করেন। অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবগণ এবং মহাপরিচালকরাও ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত ছিলেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ইতিমধ্যে বিশ্বের অনেক দেশই বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ ভাবে কাজ করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এমনকি বেশ কিছু দেশ নানা বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হেয় বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করছে। এছাড়াও বাংলাদেশ সুসম্পর্কের পরিধি বিস্তারের লক্ষ্যে বিশেষ ভাবে কাজ করছে।