প্রায় এক বছর চার মাস আগে মাথা ঘোরা, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা সমস্যায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন নেত্রকোনার জহিরুল হক জুনায়েদ (৩৯)।
পরীক্ষার একপর্যায়ে দেখা যায় তার দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। কোথাও কিডনি না পেয়ে তার স্ত্রী সায়মা জাহান পলি (২৭) তার নিজের একটি কিডনি দান করতে এগিয়ে আসেন। তার দেওয়া কিডনি নিয়ে এখন সুস্থ হয়েছেন জহিরুল হক। এ ঘটনায় স্ত্রী পলির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন।
বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের সপ্তম তলায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন এই দম্পতি।
জহিরুল হকের বাড়ি জেলার পূর্বধলা উপজেলার হিরণপুর বাজার এলাকায়। তিনি ওই এলাকার মো. মোজাম্মেল হক ও জয়নব আক্তার দম্পতির পাঁচ সন্তানের মধ্যে বড়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা জহিরুল একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। তার স্ত্রী সায়মা জাহান নেত্রকোনা সরকারি কলেজ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পাস করেন।
জহিরুল ও সায়মার পাঁচ বছরের একটি মেয়ে রয়েছে, যার নাম জুনাইনা জান্নাত রাইসা।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ছয় বছর আগে আটপাড়া উপজেলার পাঁচগজ গ্রামের সায়মা জাহানের সঙ্গে জহিরুল হকের বিয়ে হয়। বিয়ের পর তারা ঢাকায় একসঙ্গে থাকতেন। গত বছরের ২৭ মে ছুটি নিয়ে বাসায় আসেন জহিরুল। ওই দিন তার উচ্চ রক্তচাপসহ শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে স্বজনরা তাকে নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসেন।
জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তার রক্তচাপ (বিপি) ৩০০ x ২৪০ পরীক্ষা করেন। চিকিৎসক তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। সেখানে তার কিডনি রোগ ধরা পড়ে। তিনি ময়মনসিংহ ও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসা নিয়েছেন।
এরপর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ডায়ালাইসিস শুরু করেন।
সম্প্রতি তাকে ঢাকার রামপুরার একটি বেসরকারি হাসপাতালে সপ্তাহে তিনবার ডায়ালাইসিস করাতে হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে।
মাসখানেক আগে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাকে ঢাকায় চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষার পরামর্শ দেন তিনি।
পরীক্ষার ফলাফল দেখে চিকিৎসক জানান, তার দুটি কিডনি কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। রোগীকে বাঁচাতে অন্তত একটি কিডনি প্রয়োজন।
এরপর তিনি বিভিন্ন কিডনি ব্যাংকে যোগাযোগ করেও একটি কিডনি সংগ্রহ করতে পারেননি। এতে পরিবারের সদস্যরা হতাশ হয়ে পড়েন। পরীক্ষায় জহিরুলের ও স্ত্রী সায়মার কিডনি মিলেছে। এ অবস্থায় স্বামীকে বাঁচাতে নিজের একটি কিডনি দিয়েছেন সায়মা জাহান।
গত ৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে এই কিডনি প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচার করা হয়। জহিরুল বর্তমানে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিসিইউ) চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
আর সায়মা জাহানকে শনিবার হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। তিনি রামপুরা এলাকায় ভাড়া বাসায় কোয়ারেন্টাইনে আছেন।
জহিরুল ইসলামের ছোট ভাই মো. আশিকুল হক পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) হিসেবে কর্মরত।
তিনি জানান, তার স্ত্রী এখন কিছুটা সুস্থ। চিকিৎসকের পরামর্শে শনিবার হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছেন তিনি। আর ভাইয়ের অবস্থাও ভালো।
ভাবীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ভাই হয়ে আমরা যা করতে পারিনি, তা ভাবী অর্জন করেছেন। তাকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা নেই।
মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন দুজনকেই সুস্থ করেন। আপনিও দোয়া করবেন।
সায়মা জাহান বলেন, আমার স্বামীকে আমার কিডনি দিতে পেরে আমি গর্বিত। তিনি (স্বামী) কখনো বলেননি, আমি স্বেচ্ছায় কিডনি দিয়েছি।
তিনি ঠিক আছে দেখে খুব ভালো লাগছে। এখন বেঁচে থাকলে দুজনেই বাঁচব আর মরলে দুজনেই মরব।’