প্রবাসে যারা পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করে থাকেন তাদের জীবনধারা নিয়ে অনেকে বিভিন্ন কথা বলে থাকে, তবে প্রবাসীরা বিদেশের মাটিতে নানা কষ্টের মধ্য দিয়েও পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে নানা ত্যাগ শিকার করে থাকে, নিজের পরিবারের মায়া ত্যাগ করে স্বজনদের ছেড়ে পাড়ি জমান ভিনদেশে।
মিলিনার নতুন ফোনটি একটি ঝলমলে ছবি ফ্ল্যাশ করেছে। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মিলেনাকে একটি টাচ স্ক্রিন ফোন কিনে দেন তার প্রবাসী বাবা। করোনার সময় অনলাইনে ক্লাস করতে পারেনি মেয়েটি। সেই সমস্যা মেটানোর জন্য বাবা ফোন কিনেছেন। তবে নতুন ফোনের কারণে আরেকটি সুবিধা ছিল। কণ্ঠস্বর শুনতে শুনতে বাবাকে দেখাও যেত। খুলনার তেরখাদা উপজেলার উত্তরপাড়া গ্রামের এক বাড়িতে প্রতিদিন সকালে সব ছেলেমেয়ে একসঙ্গে গোল হয়ে বসত ভিডিও কলের জন্য। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি প্রবাসী মনির শেখ কর্মস্থলে যাওয়ার আগে রোজ সকালে সবাইকে একনজর দেখতেন। ২০২১ সালের ৩০ আগস্ট সকালেও কথা বলেছেন সবার সঙ্গে।
তখন কারোরই ধারণা ছিল না যে, তাদের জন্য সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে।
মনির শেখ ২০১৭ সালে কাজের সন্ধানে সৌদি আরবে যান। কয়েকদিন পর দেশে আসবেন বলে পাসপোর্ট নবায়ন করেন। মালিকের কাছ থেকে ছুটি নিলেন। পাসপোর্ট অনুযায়ী মনির শেখের বয়স ৪০, তবে তার স্ত্রী জছমিন বেগম জানান, তার আসল বয়স ৫০ এর কাছাকাছি। তিনি এক দালালের মাধ্যমে ৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা নিয়ে সৌদি আরবে যান। নড়াইলের মাহাবুর বিশ্বাস, মাসুদ বিশ্বাস রিয়াদে কাজ করার জন্য ৯০ দিনের ফ্রি ভিসা পেয়েছেন।
মনিরের স্ত্রী প্রথম বলেন, এই টাকা ধার করে তোলা হয়েছে। এর মধ্যে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা এখনো পরিশোধ করা হয়নি। তবে চার বছর পর পরিবারের কাছে না পৌঁছায় দেশে ফেরার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন মনির। তাই কয়েকদিন ধরে বাড়িতে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ছোট ছেলে রনির বয়স মাত্র চার বছর যখন তিনি সৌদি যান। সেজের ছেলে জনি এখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। আর মেজের মেয়ে মিলেনা শহীদ স্মৃতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির মেধাবী ছাত্রী। বড় মেয়ে অন্তরা বিবাহিত, তার একটি সন্তান রয়েছে। এই নাতিকে কোলে নিতে অস্থির হয়ে পড়ে মনির।
সৌদি আরবের রিয়াদে কাজের জায়গা খুব একটা সুবিধাজনক ছিল না। মনির শেখ সেখানে আরও কয়েকজন বাংলাদেশি নির্মাণ শ্রমিককে দেখতে পান। স্থান পরিবর্তন করে ২০১৯ সালে তাদের সাথে রিয়াদ থেকে আল-কাসিম প্রদেশে চলে আসেন। তিনি সেখানে বুরাইদাহ শহরে একজন নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে জীবন শুরু করেন। এই শহরে কয়েকজন মিলে বাসা ভাড়া নেন। বাসায় আসার জন্য মনিরের জিনিসপত্র অল্প অল্প করে কিনছিল। নাতির জন্য খেলনা, ছেলের জন্য কাপড়। একটু একটু করে ব্যাগ গোছাচ্ছিলেন বাড়ি ফেরার জন্য। এরই মধ্যে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন, একটু জ্বর। আমার বুকে ব্যাথা আছে। ওই দিন সকালে ভিডিও কলে কথা বলার সময় উত্তরপাড়ার ওই বাড়ির বাসিন্দারা তাঁকে দেখে একটু বিরক্ত হন।
লোকটার শরীর খারাপ হয়ে গেছে, ওজন অনেক কমে গেছে। এখনও পরিশ্রম করে সংসার চালাচ্ছেন। মনির সবাইকে আশ্বস্ত করে বলেন, তার কোনো অসুবিধা নেই। ভিডিও কলে কথা বলার এক ঘণ্টা পর সৌদি আরব থেকে আবার ফোন আসে। মনির শেখ মারা গেছেন।
প্রথমে শোকের ছায়া। তারপর শুরু হয় রহস্য। মনিরের মেস বাড়ির অন্য বাসিন্দারা একবার বলেছিলেন যে মনিরকে গুরুতর অসুস্থতার জন্য হাসপাতালে নেওয়ার সময় মারা যায়। তিনি আবার বলেন, তিনি বাড়িতেই মারা গেছেন। তাদের মধ্যে একজন আবার মনিরের পরিবারকে একটি ছবি পাঠিয়ে জানায় যে তাকে বাড়িতে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। মনিরের লাশ মেঝেতে পাতা দিয়ে বিছানায় পড়ে আছে। এরপর শুরু হয় লাশ নিয়ে আরেকটি পর্ব। এক বাসিন্দা জানান, মৃতদেহ হাসপাতালের ফ্রিজারে রাখা হয়েছে। আরেকজন জানান, পুলিশ এটি বুড়াইদহ থানার ফ্রিজারে রাখে। সেখান থেকে দেশে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
স্বামীর লাশ বাড়িতে আনার উপায় খুঁজতে খুলনার তেরখাদা থেকে রাজধানীর কাকরাইলের বোরাক টাওয়ারের একটি প্রতিষ্ঠানে আসেন মনিরের স্ত্রী জেসমিন বেগম। কিন্তু এখানেও তিনি বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। লাশ দেশে ফেরত আনার টাকা নেই। স্বামীর লাশ কোথায় রাখা হয়েছে তাও জানেন না জেছমিন। এদিকে সৌদি আরবে নিহতের স্বামীর মেসের অন্য বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, তাদের কাছ থেকে পুলিশ স্বাক্ষর করেছে। মনির শেখ তাদের কাছে কিছু টাকা জমা রাখলেও এখন তা পরিশোধ করা সম্ভব নয়।
হাসপাতাল ও পুলিশের খরচ মেটাতে তারা অনেক টাকা খরচ করেছে। বুরাইদাহ শহরের ওই মেসের বাসিন্দাদের একজন সম্প্রতি বাড়ি ফিরেছেন। তবে জেছমিন বেগম জানান, তিনি এই পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে রাজি নন।
চার সন্তানের জননী জছমিন উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে যান। তেরখাদা উপজেলা চেয়ারম্যান শেখ শহিদুল ইসলাম বলেন, “উপজেলা পর্যায়ে এ কাজের জন্য কোনো সরকারি বরাদ্দ নেই। তবে কোনো ব্যবস্থা করা যায় কিনা তা দেখার চেষ্টা করছি। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে অনুরোধ করা হয়েছে। সাহায্য চাচ্ছি।আরো সমস্যা আছে।পরিবার নিশ্চিত নয় লাশ কোথায়।
প্রবাস জীবন অনেক কষ্টের যেটা অনেকেই বুঝতে পারেন না। মানুষের ধারনা থাকে প্রবাসীরা হয়তো বিদেশে গিয়ে সুখে দিন কাটায় এবং বিপুল অর্থ উপার্জন করে বিলাসী জীবন খাটায় তবে বাস্তবতা পুরোটাই ভিন্ন। নিজের পরিবার স্বজনদের রেখে যারা বিদেশের মাটিতে থাকে তাদের কষ্টের সিমা থাকে না।